ব্যক্তিত্ব

কুন্তলীন তেল থেকে সাইকেল, মোটরগাড়ি, রেকর্ড : বাঙালিকে ব্যবসা শিখিয়েছিলেন হেমেন্দ্রমোহন বসু

মন্দিরা চৌধুরী April 16, 2022 at 5:30 am ব্যক্তিত্ব

ব্যবসাবুদ্ধির বিষয়ে বাঙালির তেমন সুনাম নেই কোনোকালেই। তবে যদি এক শতাব্দীরও আগেকার এক বিচিত্রকর্মা বাঙালির নানাবিধ ব্যবসার উদ্যোগের দিকে তাকানো যায়, তাহলে এমন ধারণা ভেঙে যায়। প্রায় শতাধিক বছর আগে অনেকগুলি শিল্প স্থাপন করেছিলেন যিনি, সেই হেমেন্দ্রমোহন বসুর কথা জানলে বিস্মিত হতে হয়। আমরা অনেকেই তাঁর সম্পর্কে বিশেষ অবগত নই। শুধু নতুন ব্যবসা পত্তনই নয়, ব্যবসা চালানো বা ব্যবসার বিভিন্ন প্যাঁচ-পয়জার বোঝার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর এবং বাঙালিকে তা শিখিয়েওছিলেন। তাই শুধু ব্যবসার বাড়িয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি, তার ঠিকঠাক বিজ্ঞাপন দিয়ে, প্রচার করে ব্যবসা ছড়িয়ে দিতেও সক্ষম হয়েছিলেন।

বিবিধ ব্যবসা করলেও হেমেন্দমোহন সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাপ রেখেছিলেন সুগন্ধির ব্যবসায়। ২১ বছর বছর বয়সে হেমেন্দ্রমোহন সুগন্ধি দ্রব্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় হেমেন্দ্রমোহনের সুগন্ধি ব্যবসার সুবিশাল বৈচিত্রের কথা। তিনি তৈরি করেছিলেন নিজস্ব খাঁটি বাঙালি ব্র্যান্ড। সুবাসিত, পদ্মগন্ধ, গোলাপ, যুঁই, চন্দন, বোকে, ভায়োলেট কুন্তলীন— এই সাত রকমের চুলের তেল ছাড়াও নানা সুগন্ধি পাওয়া যেত। আতরিন, ল্যাভেন্ডার ওয়াটার, মৃগনাভি ল্যাভেন্ডার, অ-ডি-কোলন, রোজ ও সুপিরিয়র পমেটমস, মিল্ক অফ রোজ, টয়লেট পাউডার, রোজ কার্বলিক টুথ পাউডার... তখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে হেমেন্দ্রমোহনের কল্পনা এবং তা বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা দেখে রীতিমতো অবাক হওওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। নতুন জিনিসের বাজার ধরতে তার দাম যে রাখা দরকার সাধারণের সাধ্যের মধ্যে, তা বিলক্ষণ জানতেন হেমেন্দ্রমোহন। সেইজন্য  এক বোতল বড় ভায়োলেট কুন্তলীনের দাম ছিল মেরেকেটে তিন টাকা,  দাঁতের মাজন পাওয়া যেত তিন আনায়। । এইসবের পাশাপাশি ছিল পানে খাবার তাম্বুলীন, ক্যাস্টর অয়েল— ক্যাস্টারীন, অপরাজিতা সেন্ট, স্পেশাল এসেন্স, কোকোলীন সাবান, সিরাপ, গোলাপ দন্তমঞ্জন, ফ্লোরিডা। ১৮৮১ সালের কুন্তলীন তেলের পরেই হেমেন্দ্রমোহনের কোম্পানি থেকে  'দেলখোস' সুগন্ধি এল বাজারে। এই দেলখোস এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, হেমেন্দ্রমোহনের বৌবাজার স্ট্রিটের বসতবাড়ির নামই লোকমুখে হয়ে গিয়েছিল দেলখোস হাউস। কুন্তলীন বা দেলখোসের গুণমুগ্ধের তালিকাও ছিল বিশাল, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ইন্ডিয়া কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যার কে জি গুপ্ত, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালা লাজপত রায়, মতিলাল নেহরু, কে নেই সেখানে! গুণমুগ্ধের তালিকায় এই ওজনদার নামগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়ানে এর বিজ্ঞাপন, "কুন্তলীন তৈল আমরা দুইমাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন আত্মীয়ের বহু দিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিল। কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে তাঁহার নূতন কেশোদ্গম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত, এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না।"


ব্যবসায় নিষ্ঠা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি উৎসাহ হেমেন্দ্রমোহনকে সিনেমাটোগ্রাফি, সাউন্ড রেকর্ডিং, সাইকেল-মোটরগাড়ির ব্যবসা, ছাপাখানা এরকম বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি প্রথম বাঙালি যিনি সাইকেলের দোকান খুলেছিলেন। একমাত্র তিনিই  ইংল্যান্ডের ডারকাপ সাইকেল আর রোভার সাইকেলের এজেন্সি নিয়েছিলেন, সেই সাইকেল বিক্রি করতেন হ্যারিসন রোডের দোকান 'এইচ.বোস. অ্যান্ড কোং সাইকেলস' থেকে। তাঁর  সাইকেলের দোকানের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ ছিল, এখানে সাইকেল বিক্রির পাশাপাশি ক্রেতাকে সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। হেমেন্দ্রমোহনের সাইকেলের দোকানের ক্রেতার তালিকাও ছিল চোখে পড়ার মতো; জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকারের মতো ভারিক্কি নাম ছিল সে তালিকায়। ১৯০০ সালে তিনি একটি দু-সিটের মোটরগাড়ি কেনেন এবং কিছুদিন পরেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর কোং’। পাশাপাশি, পার্কস্ট্রিটে গাড়ি মেরামতের একটি কারখানাও, ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস’ স্থাপন করেন। 

আরও পড়ুন : পনেরো বছর বয়সেই 'সাঁতারের রানি', অর্থাভাবে অলিম্পিক যাওয়া হয়নি বাণী ঘোষের / বিদিশা বিশ্বাস

ভারতবর্ষে হেমেন্দ্রমোহন প্রথম ‘প্যাথেফোন’ যন্ত্রের প্রবর্তন করেন। বিদেশ থেকে এডিসনের ফোনোগ্রাফ যন্ত্র  আনিয়ে, সিলিনডার রেকর্ডকে আবার প্যারিসের বিখ্যাত চার্লস প্যাথি কোম্পানি থেকে ডিস্‌ক রেকর্ডে পরিণত করিয়ে উদ্ভাবন করেন প্যাথেফোন যন্ত্র।  ধর্মতলায় মার্বেল হাউস নামে পরিচিত একটি বাড়ির দোতলায় এর পর খোলা হল রেকর্ডিং স্টুডিও।  এখানে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকাও নজরে পড়ার মতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, প্রমদারঞ্জন রায়, লালচাঁদ বড়়াল থেকে উস্তাদ রমজান খান, পিয়ারা সাহেব, মানদাসুন্দরী দেবী, নরীসুন্দরী, কাশীবাবু, পূর্ণ কুমারী, মহম্মদ হুসেন, দেবেন বন্দ্যোপাধ্যায়, এস সি সমাজপতি, জি জি গুপ্ত, নীরোদা বাঈ প্রমুখ। এইচ বোসের প্যাথেতে রবীন্দ্রনাথের রেকর্ডিংয়ের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল একুশেরও বেশি। লুকোচুরি, বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, অয়ি ভুবন মনমোহিনী, বন্দেমাতরম ইত্যাদি বিখ্যাত গান ছিল এই তালিকায়।

আরও পড়ুন : বিস্মৃত বাঙালি প্রসূতি-বিশারদ কেদারনাথ দাস / অর্পণ পাল 

................................



#হেমেন্দ্রমোহন বসু #কুন্তলীন #দেলখোস #বাঙালি উদ্যোগপতি #রেকর্ডিং #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal #বাংলা পোর্টাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

58

Unique Visitors

181837