মুক্তগদ্য

গুপ্তধন

বিতান ঘোষ July 22, 2022 at 7:35 am মুক্তগদ্য

হাত আর হাতছানির ফারাক ভুলিয়ে দেয় অভ্যাস। ঈশ্বরের নির্মাণ এতই গভীরে যে, নাস্তিকও অবচেতনে জীবনের নানান কাজ বা সম্পর্কে কোনো এক মানুষ, আদর্শ বা প্যাশনের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর গড়ে তোলে - বা নিজেই হয়ে ওঠে ঈশ্বর। সেই অবচেতন তো আমার চেয়েও বড় এমন এক আমি - যিনি আমারই আড়াল থেকে গোপন আস্তিনে লুকোনো একের পর এক তুরুপের তাস বের করে চলেন। ঈশ্বর তাদের মধ্যে এমন এক টেক্কা বা ট্রাম্পকার্ড যেখানে কনভিকশন আর কনভেনিয়েন্স দ্বন্দ্ব ভুলে এক ঘাটে জল খায়। সেই গহীন প্রদেশে, মলম আর আঘাত একই স্থান থেকে পেতে পেতে,যত্নের ভ্রমে তা প্রায় সমার্থক হয়ে যায়। তারপর জীবনে আসে সেকেন্ড ইনিংস, যার ছত্রে ছত্রে থাকে এই ঈশ্বরের বিনির্মাণ। শুরুতে বেশ কঠিন হয়। খুব নস্ট্যালজিক লাগে। মনে হয় ছোটবেলাই ভালো ছিল। ফিরিয়ে দাও সেই উত্তেজনার এবং কৌতূহলের দিন ইত্যাদি, প্রভৃতি। তখন লোভের মতই মাঝেসাঝে ঈশ্বরও আসেন। ছদ্মনামে। এই যেমন নিজেই নিজের ঈশ্বর হয়ে উঠবার একটা মরীয়া প্রয়াস। ধীরে ধীরে নিজের প্রতি এই পাহাড়প্রমাণ চাপ নিতেও আর ভালো লাগে না। মনে হয় সমস্তের মধ্যেই সব আছে।

 

তখন আসে এক ধীর-স্থির অনুভূতি। সমুদ্রের তো তটেই যত ঢেউ। মাঝসমুদ্র মোটের ওপর শান্ত। তটস্থ বিচার ছেড়ে গভীরে যাওয়ার মতই এ অভিজ্ঞতা। হারানোর সেভাবে কিছুই নেই বুঝতে পেরে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা কমে আসে। বরং যা আছে তাকেই নতুন-নতুন চেহারায় আবিষ্কার করতে থাকি আমরা। কিছু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অভিমুখ বদলাতে থাকে, অভিপ্রায় স্তিমিত হয়, বাড়তে থাকে অভিঘাত। অন্যকে অভিযুক্ত করার আগে নিজেকেই প্রশ্ন করে ফেলি, আর তখনই ছুঁয়ে ফেলি সেই জাদুকাঠি। দেখতে পাই, সব উত্তর আমাদের ভিতরেই আছে। মাঝেমধ্যেই রেট্রোস্পেক্ট-এর ছুতোয় করে ফেলি ইন্ট্রোস্পেক্ট।


 রাগের নদীতে ডুব দিয়ে দেখি তলায় রয়েছে কষ্টের নুড়িপাথর। কষ্টের পাথরে পা রাখতে গিয়ে দেখি তাকে বয়ে নিয়ে চলেছে লোভের চোরাস্রোত। লোভের ঠিকানা জানতে চাইলে সে পাহাড়ের মত থম মেরে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। জিগ্যেস করি "তুই কে? আমার সাথে আছিসই বা কেন?"

জিজ্ঞেস করলে লোভ বারবার প্রতিধ্বনিই ফেরত দেয়।তখন  আমার অনুভূতিগুলোকে আমারই মতো  সত্য মনে হয়।তাদের অস্বীকার করতে গেলে নিজেকেই অস্বীকার করার কষ্ট হয়। ক্রমে তাদের সাথে সহাবস্থান শুরু হয়। সুযোগ বুঝে ভূমিকা পরিবর্তন করি। কখনো তাদের অভিভাবক হয়ে উঠি,  কখনো সন্তান।


নিজের অনুভূতিগুলোর প্রতি যেন সন্তানসম এক মায়া তৈরি হয় ধীরে ধীরে। ওদের সঙ্গে শুরু হয় সংলাপ। ওরাও যেন আগের মতো বেপরোয়া থাকে না আর। হয়তো বুঝে যায় আমি ছাড়া ওদেরও কেউ নেই বহন করার, পোষ মানানোর, হাত ধরার। আস্তে আস্তে তৈরি হয় সম্পর্ক। পাওয়া যায় এমন এক দোসর, যে ঠিক তুমিও নও, আমিও নই, সে-ও নয়। এই সবকিছুকে অতিক্রম করা মৃত্যুর মতোই স্থবির এক সত্য।ধীরে ধীরে দৈনন্দিনের মেলামেশায়, সেই দোসর আর আমি তারপর কখন যেন একটাই মানুষ হয়ে উঠি।


ঈশ্বরের মৃত্যু ঘটে। আমরা প্রথমবার পুনর্জন্মের স্বাদ পাই। শুধু জাতিস্মর হয়ে মাঝে মাঝে তার যাতায়াতে, অতীতের মধ্যেই ফিরে-ফিরে আসে আগামীর কোনো এক সংখ্যা।


অলংকরণ: ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

#বিতান ঘোষ #মুক্তগদ্য #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

86

Unique Visitors

181879