বিবিধ

পেন, স্ক্যালপেল, Life (পঞ্চম ভিজিট)

ঋতঙ্কর পাত্র July 2, 2021 at 6:04 am বিবিধ

গতকাল ছিল ডাক্তারদের দিন। এই বছর এ দিনটা কোভিডে মৃত ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত।

মাঝেমাঝেই কানে আসে, ডাক্তাররা ভগবান। আর ভগবানের মৃত্যু হয় না। কিন্তু ডাক্তাররা মারা যান। সমস্ত মানুষ যেভাবে মারা যান, ডাক্তাররা সেভাবেই মারা যান। আলাদা করে ‘ডাক্তার ইস্পেশাল’ কোনও রোগ-জ্বালা হয়না আমাদের। মাঝে মধ্যে পেশেন্টরাই কিছু রোগ দিয়ে যায়। যেমন কোভিড। শেষ দু মাসে ভারতবর্ষের 776 জন ডাক্তার এই অতিমারীর কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। এরপর আছে পাবলিকের মার। তবু, যখন ছোটো কাউকে জিজ্ঞেস করি যে বড় হয়ে কি হবে, তার উত্তরে যখন শুনি “ডাক্তার!", ভালো লাগে। আবার মায়াও লাগে। আজন্মকাল ধরে পড়াশোনা, পাবলিকের মার, এসব মাথায় রেখেও কেউ যখন বলে ডাক্তার হব, তখন তাকে আর কী-ই বা বলা যায়। 


কিন্তু এসব করে আসলে কী পাওয়া যায়? টাকা পয়সা? হ্যাঁ, সে কাজের তুলনায় কম আসে। পরিবারকে সময় দেওয়া? সেটা হয় না। বন্ধুবান্ধবদের সাথে হাসি ঠাট্টা মজা ঘুরতে যাওয়া? সেও কমে যায়। শরীর-স্বাস্থ্য বিগড়ে যাওয়ার কথা আর না হয়  নাই বললাম। তাহলে ঠিক কী পাওয়া যায়? 

গত বছর লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক আগে এক পেশেন্টের অপারেশন চলাকালীন আচমকা হার্ট অ্যাটাক হয়। তার পা পচে গেছিল। সেই পায়ের পচা অংশ কেটে বাদ দেওয়া হচ্ছিল। সেই সময় এই ঘটনা। অপারেশান থামিয়ে আমরা যখন মনিটরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, তখন অ্যানাস্থেসিস্টদের চেষ্টায় মনিটরে  হার্টবিট আর ইসিজির আঁকাবাঁকা লাইন ফিরে এল। আমরা ঝড়ের বেগে বাকি কাজ শেষ করে পেশেন্টকে যখন ওয়ার্ডে পাঠালাম তখন পেশেন্ট খাবি খাচ্ছে। আমরা এক্ষেত্রে সময় গুনি যে পেশেন্ট আর কত ঘন্টা বাঁচবে। এমন করে একদিন যায়, দুদিন যায়। এদিক ওদিক অন্যান্য পেশেন্টের জন্য কাজকর্ম করে যাই। ৪-৫ দিন পরে দেখি পেশেন্ট উঠে দিব্যি খাবার খাচ্ছে। কেমন আছে জানতে চাইলে বলে ভালোই আছি। এদিকে সে যে ৪ মিনিটের জন্য পরলোকের দোর থেকে সেদিন ঘুরে এসেছিল, সেটা আমাদের থেকে ভালো কেউ জানে না। 

পেশেন্টের পা আর ঠিক হয় না। হার্ট এবারে ঠিকঠাক কাজ করে, কিন্তু পা আরও পচে যেতে থাকে। আমরা আবার পায়ে ছুরি কাঁচি চালাই। ১২-১৪ দিন পর একদিন সকালে এসে দেখি পেশেন্ট ওয়ার্ডে নেই। আবার বুক ধড়াস করে ওঠে। তাহলে কী আবার হার্ট অ্যাটাক হল? সিস্টারদের থেকে জানা যায়, পেশেন্টের আর থাকতে ভালো লাগছিল না বলে সে আগের দিন পালিয়ে গেছে। আর ওয়ার্ডে থাকতে চায়নি। মনে মনে তিন-চারটে বাছা বাছা গালাগাল দিই। এত খাটলাম আর এই তার পরিণতি? মাঝেমাঝে তাই মনে বড্ড বেশি হতাশা ভিড় করে আসে । 

কিন্তু সবাই তো আর এমন অকৃতজ্ঞ হয় না।  

অনেকদিন আগের কথা, তখন আমি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন। একদিন আমার ইমার্জেন্সি নাইট ডিউটি চলছে। সার্জারি পোস্টিং। সঙ্গে আছে হাড়ের ডিপার্টমেন্টের একজন ইন্টার্ন, আর আমার বন্ধু অর্ণব। সে এমনিই এসেছে আড্ডা মারতে। গল্প-আড্ডায় ভালোই সময় কাটছে। সেদিন পেশেন্ট কম। আমাদের মন খুশ। রাত দুটো নাগাদ একজন পেশেন্ট এলো হাঁটতে হাঁটতে। 

-"ডক্টর, আমার গা-হাত-পা চুলকাচ্ছে।" 

অন্য সময় হলে রাম খিস্তি খেত। শালা! রাত বিরেতে ইয়ার্কি মারার জায়গা পাওনি? একটু ভদ্রসভ্য পোশাক দেখে আর মনমেজাজ সেদিন ভালো বলে আমি জিগ্যেস করি, -"হঠাৎ চুলকানি কেন শুরু হল?" 

-"আসলে আমার সালফা group of drugs এর ওষুধ খেলে একটু গা-হাত-পা চুলকায়। অ্যালার্জির মতো হয়।" 

-"তা খেলেন কেন সালফা ড্রাগ?" 

-"আমি খাই না স্যার। দোকানে কিনতে গেছিলাম একটা ওষুধ। সেটা ছিল না। জোরজার করে এটা দিয়ে দিল। আমি তো জানতামই না.." 

ভদ্রলোক দেখি ভালোই হাত-পা চুলকাচ্ছেন। 

-"ঠিক আছে। এই ওষুধটা আমাদের এখানে নেই। ঠিক বাইরেই দোকান আছে। পেয়ে যাবেন। একটু কিনে আনুন।" 

ভদ্রলোক চলে যান। আমরা আবার আড্ডা শুরু করি। পেশেন্ট যেন সেদিন একটু বেশিরকমেরই কম। কথায় বলে, যেদিন রাতের শুরু ভালো যায়, রাতের শেষ সেদিন কাঁদিয়ে ছাড়ে। কথাটা সেদিনের আগে অবধি বিশ্বাস করিনি। যাই হোক, মিনিট দশ পর ভদ্রলোক ফিরে আসেন। এসে আমাদের হাতে ওষুধটা দিয়েই ধপাস করে মাটিতে পড়ে যান। 

আমরা কোনোমতে ওনাকে বিছানাতে তুলে দেখি ওনার জিভ পুরো নীল। নাকের ডগা নীল। হাতের আঙুলও নীল। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে cyanosis। আর ওনার যেটা হয়েছে সেটা severe anaphylaxis। আমাদের যাকে বলে আক্কেল গুড়ুম। সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারটে ওষুধ আর ইনজেকশন, সঙ্গে adrenaline। ম্যাজিকের মত কাজ হল। ১০ সেকেন্ড পরেই পেশেন্ট বলে ওঠে, ভালো লাগছে। 

জিভ আস্তে আস্তে নীল থেকে স্বাভাবিক রঙে ফিরে আসে। প্রচন্ড বেগে চলতে থাকা হার্ট আবার নিজের ছন্দে। ১০ মিনিটে পেশেন্ট স্বাভাবিক। আমাদের বুক থেকে একটা মস্ত বোঝা নেমে যাওয়ার মত অবস্থা। 

ঠিক হতেই ভদ্রলোক বলেন, বাড়ি যাব। 

আমি বলি, ‘বাড়ি গিয়ে করবেনটা কী। আজ তো আপনাকে ভর্তি হয়ে অবজার্ভেশানে থাকতে হবে।’’ 

ভদ্রলোক রাজি হলেন। একা এসেছিলেন, একাই ভর্তি হলেন। একাই থাকলেন। পরদিন সকালে যখন বাড়ি যাচ্ছি, দেখি ওই ভদ্রলোক ইমার্জেন্সির সামনে দাঁড়িয়ে। সামনে যেতেই বললেন, "আপনার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। আমায় ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আমার আসলে বাড়িতে কেউ ছিল না। ঘুরতে গেছে সবাই। আমি ছাত্রদের ক্লাসের জন্য থেকে গেছিলাম।" 

"আচ্ছা, কী পড়ান আপনি?" 

"আমি রাজ কলেজের Economics এর হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট।"  

শুনে চোখ গোল গোল করে তাকাই। 

"ভালো থাকবেন। আপনাকে আর আপনার বন্ধুকে অজস্র অজস্র ধন্যবাদ।" ভদ্রলোক চলে যান। 

গর্বে সেদিন বুক ভরে গেছিল। 

আরও পড়ুন : পেন, স্ক্যালপেল, LIFE (চতুর্থ ভিজিট) / ঋতঙ্কর পাত্র 

আসলে আমরা এসবের জন্যই অপেক্ষা করে থাকি। কোনো দামি উপহার না, কাঁচা টাকা না, দামি গাড়ি না - শুধু বাড়ি যাওয়ার আগে একটু ধন্যবাদ। প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। উদয়াস্ত পরিশ্রমের জন্য ধন্যবাদ।

অপারেশানের পর কোনও পেশেন্ট খারাপ থাকলে আমার স্যার সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেন না। রোগীর বিছানার পাশে বসে জেগে থেকে স্যারকে আপডেট জানাই আমরা। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে আমাদের মনে শান্তি। আমরা চাই এটার জন্য শুধু একটু ধন্যবাদ। আমরা ওতেই খুশি। অনেকে ধন্যবাদ বলে না। দরকারে ফোন করে। সব জেনে নেয়। ঠিক হয়ে যায় কিনা আর বলে না। আমরা ধরে নিই ঠিক হয়ে গেছে। নইলে আবার আসত ফোন। পরে দেখা হলে বলে, "সেদিন যা একখানা ওষুধ দিয়েছিলি!" আমরা ধরেই নিই, ওটাই অনুচ্চারিত এবং বিলম্বিত ধন্যবাদ। 

আরও পড়ুন : পেন, স্ক্যালপেল, LIFE (তৃতীয় ভিজিট) / ঋতঙ্কর পাত্র

আর এত কিছুর পরও যদি কেউ বাড়ি না ফেরে?  অজস্র মৃত্যু দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত। তবু অনেক মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তোলে। ১৮ বছরের ছেলে বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেলে আমাদের মনটা সত্যি ধাক্কা খায়। আবার ২১ বছরের মা বাচ্চার জন্ম দেওয়ার সময় মারা গেলে সেটাও কম ধাক্কা দেয় না। তবু ধাক্কা যেন অনেক কম লাগে আজকাল। জন্ম-মৃত্যুর ধারাপাত রোজ  ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমরা বোধহয় আস্তে আস্তে পাথর হয়ে যাচ্ছি। কোনও কিছুই আর সেভাবে নাড়া দেয় না। খুব আশা করব অন্য কেউ যেন এরকম না হয়ে যায়। আমি চাই সবাই যেন এরকম না হয়ে যায়।


[লেখক নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক] 

...........................................

[কভার : অর্পণ দাস]



#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal #পেন স্ক্যালপেল Life #গদ্য #Doctor #Medical #ঋতঙ্কর পাত্র #অর্পণ দাস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

97

Unique Visitors

182518