বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ভেরা রুবিন : ডার্ক ম্যাটারের প্রথম সন্ধান পেয়েছিলেন যিনি

অর্পণ পাল May 10, 2022 at 11:20 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মহাবিশ্ব ছেয়ে আছে এমন এক ধরনের অদৃশ্য পদার্থে, যার অস্তিত্বের স্বপক্ষে অনেক প্রমাণই আছে, কিন্তু যাকে কোনোভাবেই দেখা বা অন্য কোনো ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুধাবন করবার উপায় নেই একটুও। অথচ ইদানীংকার হিসেব বলছে মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় চুরাশি শতাংশ ভর এই অদৃশ্য পদার্থের জন্যই। আমরা যেমন এক বাতাসের এক বিরাট চৌবাচ্চার মধ্যে ডুবে রয়েছি অথচ সেই চৌবাচ্চার মধ্যে থাকাটা একেবারেই বুঝতে পারিনা, ঠিক তেমনই এই মহাবিশ্ব পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে আছে এক অদৃশ্য সর্বত্রব্যাপী পদার্থের মধ্যে, যার নাম ‘ডার্ক ম্যাটার’, এর ভালো বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি হয়নি এখনও। দৃশ্যমান বস্তুর ভেতর দিয়েও ভেদ করে যেতে পারে অনায়াসে, এমন সর্বব্যাপী এই বস্তু নিয়ে তাই বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথা থাকবে, এ খুবই স্বাভাবিক। আর যাঁরা মহাবিশ্বের গঠন বা এর বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন, তাঁদের কাছে এ বস্তুর আকর্ষণ আরও বেশি কারণ এই বস্তুর উপস্থিতিই আসল প্রভাব ফেলে গ্রহ-নক্ষত্রের গতি বা একটা গ্যালাক্সি অন্য গ্যালাক্সিকে কীভাবে আকর্ষণ করছে, সেরকম সব ঘটনার ক্ষেত্রেও।

পঞ্চাশ বছরের বেশি আগে প্রথমবার যখন এই পদার্থের অস্তিত্বের কথা নজরে আসে এক আমেরিকান মহিলার, তিনি সবিস্ময়ে বলেছিলেন, ‘একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সির মধ্যে যা কিছু আমরা দেখছি, আসলে তা কিছুই নয়। আসল যেটা, সেটা আমরা দেখতেই পাচ্ছি না।’ 


সেই আসল বস্তু, যার নাম ডার্ক ম্যাটার, তার আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ওই মহিলার নাম, অথচ তিনি এর জন্য পাননি বড় মাপের কোনো পুরস্কারই। এই লেখা, সেই ভেরা রুবিন-কে নিয়েই। 


***

সত্তরের দশকের প্রথম দিকে ওয়াশিংটন-এর কার্নেগি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভেরা রুবিন জোট বাঁধেন আর এক গবেষক কেন্ট ফোর্ড-এর সঙ্গে। তাঁদের লক্ষ ছিল, স্পাইরাল গ্যালাক্সি বা প্যাঁচালো আকারের ছায়াপথদের পর্যবেক্ষণ করা। এ জন্য তাঁরা বিভিন্ন গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণ আর তাদের উপাদান তারাদের ঘূর্ণন বেগ। 

কিন্তু তাঁরা সবিস্ময়ে দেখেন, গ্যালাক্সির মধ্যে থাকা বিভিন্ন তারাদের যে ঘূর্ণনবেগ, সেটা তাঁদের হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি। গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরের দিকে থাকা (সংখ্যায় কম এবং দূরে দূরে থাকা) তারাদের যা ঘূর্ণনবেগ, কেন্দ্রের কাছাকাছি (ঘন এবং কাছে কাছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা) তারাদের বেগও তাই। কিন্তু এই ব্যাপারটা তো সরাসরি নিউটনের সূত্রকেই অমান্য করছে! স্কুলে পড়াকালীন বস্তুর ঘূর্ণন অধ্যায়ে আমরা জেনেছিলাম যে যখন কোনও পাতলা চাকতি ঘোরে, তখন তার সবচেয়ে বাইরের প্রান্তের বেগ হয় সবচেয়ে বেশি। অন্যভাবে বললে কেন্দ্রীয় অক্ষ থেকে যে বিন্দু যত দূরে, তার গতিও তত বেশি। আবার আরও একটা ব্যাপার ওঁরা খেয়াল করলেন, অত বেশি জোরে ঘুরলে তো ওর উপাদানগুলোর চারদিকে ছিটকে যাওয়ার কথা। সেটাও হচ্ছে না বাস্তবে। তাহলে? 

রুবিনেরা তখন ধরে নেন, গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এমন ভারী কিছু রয়েছে, যা একটা আঠার মত আটকে রেখেছে চারপাশের বস্তুগুলোকে। যে কারণে ওর কেন্দ্রীয় অঞ্চল আর বাইরের দিকে, এই দুটো এলাকাতেই থাকা তারাদের ঘূর্ণন বেগে রয়েছে অত মিল। এমনিতে জ্যোতির্বিদেরা মনে করতেন যে কোনো একটা গ্যালাক্সির ভেতর বা কেন্দ্রের দিকে তারাদের ভিড় সাধারণত বেশি হয়। যে কারণে তাঁরা মনে করতেন গ্যালাক্সির মোট ভরের বেশিরভাগই আসলে ওর কেন্দ্রের দিকের ভর। আর কেন্দ্রের দিকের ভর বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মহাকর্ষীয় আকর্ষণও বেশিই হবে। আর সেক্ষেত্রে যে তারা গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে যত দূরে থাকবে, তার ঘূর্ণন বেগও তত কম হবে। কিন্তু রুবিনদের পরীক্ষালব্ধ ফল এই ধারণাকে নস্যাৎ করে দেয়। 

এর আরও বছর দুই পর ওই প্রিন্ট করা তথ্যে ভরা কাগজগুলোই হয়ে দাঁড়ায় ডার্ক ম্যাটারের পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। যা পরবর্তীকালে সত্যি বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তবে এখানে এটাও বলে রাখা দরকার, ভেরা রুবিন-দের অনেক বছর আগে ১৯৩৩ সালে ফ্রিৎজ জুইকি নামে এক জ্যোতির্বিদ ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের কথা খাতায়কলমে দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সেদিন তাঁর কাছে ছিল না কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ। যে কারণে তাঁর কথায় অনেকেই বিশ্বাস করেন নি। ভেরা রুবিন-দের পরীক্ষালব্ধ সিদ্ধান্ত ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে। 


***

১৯২৮ সালের ২৩ জুলাই ভেরা কুপার-এর জন্ম আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে। পরে তাঁদের পরিবার ওয়াশিংটনে বসবাস শুরু করে। এখানে থাকবার সময়েই ভেরার জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। রাতের বেলা ভেরা আর তাঁর দিদি দুজনে যে বিছানায় শুয়ে থাকতেন, তার ঠিক পাশেই ছিল একটা বড় জানালা, আর সেই জানালা দিয়ে দেখা যেত উত্তর দিকের অনেকখানি বাধাহীন আকাশ। আর ওই আকাশের বুকে রাতের বেলা ফুটে উঠত অজস্র জোনাকিদলের মতো তারারা। দিনের পর দিন ওদের লক্ষ করতে করতে ভেরা টের পান, তারারা আসলে চলমান, ঘুরে চলেছে ওরা। এর কিছু পরে ভেরা একটি টেলিস্কোপ কেনেন, যার ফলে আকাশ পর্যবেক্ষণ তাঁর কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাঁর বাবা তাঁর এই জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আকর্ষণের বিষয়টি জানবার পর মোটেই আপত্তি জানাননি, বরং সবসময় চেষ্টা করেছেন তাঁর পাশে দাঁড়াবার। যদিও তাঁর মনে সংশয় ছিলই, আমেরিকায় একজন মেয়ে হয়ে ভেরা এই ক্ষেত্রটিতেই বলার মতো কেরিয়ার আদৌ গড়ে তুলতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে। 

ভাসার কলেজ থেকে একমাত্র মেয়ে হিসেবে অ্যাস্ট্রোনমি বিষয় নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হলেন ভেরা। গবেষণা শুরু করলেন মার্থা স্টার কারপেন্টার-এর কাছে। এর আগে তিনি প্রিন্সটনে আবেদন করতে গিয়ে জানতে পারেন যে এই প্রতিষ্ঠানে জ্যোতির্বিদ্যার বিভাগে মেয়েদের ভরতি নেওয়া হয় না। তবে কর্নেলে ভরতি হয়ে তাঁর সুবিধেই হয়েছিল। এখানে তিনি রিচার্ড ফেইনম্যান, হানস বেথে বা ফিলিপ মরিসন-এর মতো বড় মাপের পদার্থবিদদের সঙ্গ পেয়েছিলেন। কর্নেল থেকে পরে ভেরা চলে যান জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখানে তিনি জর্জ গ্যামো-র কাছে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৫৪ সালে। অবশ্য এর বছর কয়েক আগেই ১৯৪৮ সালে তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে রবার্ট জোশুয়া রুবিন নামে এক গণিতের অধ্যাপকের, ভেরা কুপার হয়ে গিয়েছেন ভেরা রুবিন। এই জর্জটাউনেই বছর কয়েক পড়াবার পর ভেরা আবার ওয়াশিংটনের কার্নেগি ইনস্টিটিউশনে চলে আসেন। আর এখানে আসবার পরেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় কেন্ট ফোর্ডের, যা তাঁর জীবনে আর একটা বাঁক বদল এনে দেয়। এখানে আসবার পর ভেরা কাজ শুরু করেন গ্যালাক্সিদের গঠন আর গতির বিষয়ে। 

দূর গ্যালাক্সিদের থেকে আসা অতি ক্ষীণ আলোকে স্পেক্ট্রোমিটার বা বর্ণালিবিশ্লেষক যন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। কাজটা বড়ই কঠিন। আর পরিশ্রমসাধ্যও বটে। তবু ভেরা আর তাঁর গবেষণা সঙ্গী কেন্ট ফোর্ড দিনের পর দিন দেখতে থাকেন কীভাবে একটা প্যাঁচালো বা স্পাইরাল গ্যালাক্সির সদস্য তারাগুলি বৃত্তাকার বিভিন্ন পথে ঘুরে চলেছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে। এখন যদি কোনো একটা গ্যালাক্সি আমাদের চোখের সামনে ত্যারচাভাবে থাকে, তখন আমরা ওই গ্যালাক্সির সামনের দিকের তারাদের যদি ডান দিক থেকে বাম দিকে ঘুরতে দেখি, তবে ওই গ্যালাক্সির পিছন দিকের তারাদের বাম দিক থেকে ডান দিকে ঘুরতে দেখব। আআর একদিকের তারাদের দেখব আমাদের দিকে সরে আসতে, অন্যদিকের তারাদের দেখব আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে। আবার বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডপলার-এর এক আবিষ্কার থেকে আমরা জানি যে যে তারা আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তা থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সরে যায় লালের দিকে, আর যে তারা আমাদের কাছে আসতে থাকে, তা থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সরে আসে নীলের দিকে। এই ঘটনা ডপলার ক্রিয়া নামে পরিচিত। তারাদের গতির ওপর এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সরণের মাপ নির্ভর করে। ভেরা রুবিন আর কেন্ট ফোর্ড এই ডপলার ক্রিয়াই পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলেন বেশ কিছু গ্যালাক্সি থেকে আসা তারাদের আলো বিশ্লেষণ করবার মাধ্যমে। পাশাপাশি মাপছিলেন গ্যালাক্সির মধ্যে থাকা বিভিন্ন তারাদের কক্ষপথে ঘুরবার বেগও। তারপর তাঁরা কী আবিষ্কার করলেন একদিন, সেটা তো একটু আগেই বলেছি। 

আরও পড়ুন : বিস্মৃত বাঙালি প্রসূতি-বিশারদ কেদারনাথ দাস / অর্পণ পাল

***

ভেরা রুবিনের নোবেল না পাওয়া নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। তাঁরই সমসাময়িক এক ঝাঁক বিজ্ঞানী পরবর্তীকালে পেয়েছেন এই পুরস্কার। নিউট্রিনো বা ব্ল্যাক হোল বা গড পার্টিকেল, এরকম অনেক বস্তুর আবিষ্কারই নোবেল জিতিয়েছে আবিষ্কারকদের। অথচ ব্রাত্য রয়ে গিয়েছেন ভেরা রুবিন। তাঁর যখন সাতাশি বছর বয়স, তখনও বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে যে নোবেল কমিটির কাছে তিনি নিজেই কি এক ডার্ক ম্যাটারে তৈরি মানুষ, যাঁকে তাঁরা দেখতেই পান না?

আরও পড়ুন : মারি-অ্যানে ল্যাভয়সিয়ে: আধুনিক রসায়নের বিস্মৃত জননী / অর্পণ পাল

 ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যোতির্বিদ এমিলি লেভেস্কিউ একবার বলছিলেন, আলফ্রেড নোবেল তাঁর নোবেল ঘোষণাপত্রে পরিষ্কার লিখেছিলেন যে পদার্থবিদ্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর যুগান্তকারী আবিষ্কারকে নোবেল দেওয়া উচিত। ডার্ক ম্যাটার যদি সেরকম কিছু আবিষ্কার না হয়, তবে সেরকম আবিষ্কার আর কী আছে, জানতে খুব মন চায়। 

নোবেল না পাওয়াই শুধু নয়, রুবিন সারা জীবনে আরও বহুবার সম্মুখীন হয়েছে লিঙ্গ-অসাম্যজনিত বাধার। তবু নিজের কাজে কখনও ঢিলেমি দেননি একটুও। কাজের মধ্যে দিয়েই নিজের মতো করে লড়ে গিয়েছেন এই অসাম্যের বিরুদ্ধে। 

২০১৬ সালে অষ্টআশি বছর বয়সে রুবিনের মৃত্যু হয়। ডার্ক ম্যাটারের আবিষ্কর্তা হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি মিলেছে, এটাই একমাত্র সাফল্য তাঁর। 

…………………………………… 

#Vera Rubin #American astronomer #Dark Matter #Feature #Silly পয়েন্ট #Bengali Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

29

Unique Visitors

181926