বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

হিরের দুল ছেড়ে চেয়েছিলেন বই - শতবর্ষে বিস্মৃত বিজ্ঞানী আন্না মনি

সিদ্ধার্থ মজুমদার Mar 23, 2021 at 11:09 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

‘We have only one life. First equip yourself for the job, make full use of your talents and then love and enjoy the work, making the most of being out of doors and in contact with nature’ – Miss Anna Mani

উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত একটি সিরিয়ান খ্রিষ্টান পরিবার। আট বছরের জন্মদিনে পরিবারের ছোট্ট মেয়েটি যখন জানতে পারে হিরেখচিত কানের দুল উপহার দেওয়া হবে তাকে, সে তা নিতে অস্বীকার করে। কারণ দুল নয়, তার বদলে সে চায় ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র সব ক’টি খন্ডের একটি সেট। অনেক ছোটো থেকেই বইয়ের পোকা সেই মেয়ে। কেরালার ট্রাভাঙ্কোরের রমনাথপুরম পাবলিক লাইব্রেরিতে মালয়লি ভাষায় যত ধরনের বই ছিল ওই বয়সেই তা পড়া হয়ে গেছে। বারো বছর বয়সের মধ্যে ওই লাইব্রেরির সব ইংরেজি বইও পড়া হয়ে যায়। পরিবারে ছোটোবেলা থেকেই ছেলেদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বেশি যত্ন নেওয়া হত আর মেয়েদের করে তোলা হত বিয়ের উপযোগী। কিন্তু সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পিতা তাঁর এই সপ্তম সন্তানটির অন্যধারার পছন্দের পথে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াননি। 

মেয়েটির নাম আন্না মোডায়িল মনি (১৯১৮-২০০১)। তিনবছর আগে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পেরিয়ে এসেছি, তবু ক’জন বিজ্ঞান পড়ুয়া তাঁর নাম শুনেছি? লজ্জাজনক হলেও সত্যি এটাই যে, তিনজন ভারতীয় কৃতবিদ্য মহিলা বিজ্ঞানীর নাম বলতে বললে আমরা অনেকেই বলতে পারব না। সেরকমই আন্না মনির নামও আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। আন্না মনির পরিচয় একজন মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আবহাওয়া বিশারদ (মিটিয়োরোলজিস্ট) হিসেবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অতীব মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ তাঁর অবদান। তাঁর মেধা এবং সৃজনশীলতার জোরে তিনি ইন্ডিয়ান মিটিয়োরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে ‘ডেপুটি-ডিরেক্টর জেনারেল’ পদে আসীন হয়েছিলেন। 


আন্না মনি ১৯৩৯ সালে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নবিদ্যা নিয়ে তৎকালীন মাদ্রাসের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হলেন। এরপরেই ব্যাঙ্গালোরে বিখ্যাত ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স-এ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি. ভি. রমনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্যে স্কলারশিপ পেলেন। রুবি এবং ডায়মন্ডের অপটিক্যাল (আলোক) ধর্ম নিয়ে উন্নতমানের গবেষণা শুরু হল। সে এক দীর্ঘ সময় আর নিরবিচ্ছিন্ন ধৈর্যের পরীক্ষা! বত্রিশটি ‘ডায়মন্ড’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন আন্না, কখনও কখনও একটানা পনেরো-কুড়ি ঘণ্টা পেরিয়ে যেত এক্সপেরিমেন্ট শেষ হতে। কখনও বা সারাদিনের খাটুনির পরে আবার সারা রাত ধরে চলত এক্সপেরিমেন্ট। অবশেষে এই কাজের ওপর তাঁর পাঁচটি উন্নতমানের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল, ১৯৪৫-এ পিএইচডি থিসিস জমা দিলেন মাদ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। 


ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা একবার আন্নার কয়েকবছর আগের পরিস্থিতি ফিরে দেখতে চাই। জানতে চাই, অন্য একজন মহিলা বিজ্ঞানীর অভিজ্ঞতা। ইন্দোরের মেয়ে কমলা সাহানি, আন্নার থেকে মাত্র ছ’বছরের বড়ো। বস্তুত কমলাই প্রথম মহিলা গবেষক হিসেবে সি ভি রমনের কাছে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ‘সুযোগ পেয়েছিলেন’ বলাটা ভুল, সুযোগ আদায় করে নিতে হয়েছিল কমলাকে। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৩-এর ব্যাচে ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রিতে প্রথম স্থানাধিকারী ছিলেন কমলা, স্কলারশিপও পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন স্বাভাবিকভাবেই আইআইএসসি-তে গবেষণার সুযোগ জুটে যাবে। কিন্তু স্বাভাবিক মানেই যে সহজ নয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন কমলা। মেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ঘোর বিরোধী ছিলেন সি. ভি. রমন। তাই স্কলারশিপ থাকলেও, কমলার আবেদনপত্র নাকচ করে দিলেন রমন। কমলাও অত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন। বিজ্ঞানে তাঁর সর্বোচ্চ নম্বর এবং স্কলারশিপ পেয়েও কেন গবেষণার সুযোগ পাবেন না? এর সদুত্তর না পাওয়া অবধি রমনের অফিসঘরের সামনে ধর্নায় বসলেন। বাধ্যত সে সুযোগ দেওয়া হল তাঁকে, কিন্তু on-probation এবং শর্ত সাপেক্ষে। কী শর্ত? ‘কমলার উপস্থিতি যেন কখনও কোনোভাবেই অন্যান্য পুরুষ গবেষকদের বিরক্তির কারণ না হয়’। 

থমকে গেলেন বুঝি? গা রি রি করছে? কিন্তু ১৯৩৩ সালে দাঁড়িয়ে কমলার পক্ষে কিছু করার ছিল না ওই অপমানজনক শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া। আইআইএসসি-তে প্রথম মহিলা গবেষক কমলা সাহানির স্মৃতিচারণটি পড়লে সেই সময়ে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কী প্রতিবন্ধকতা ছিল তার আন্দাজ পাওয়া যায়। কমলা লিখছেন - “যদিও রমন একজন মহান বিজ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু তাঁর মানসিকতা ছিল অতীব সংকীর্ণ। আমি কখনও ভুলতে পারব না, কেবলমাত্র একজন মহিলা বলে তিনি আমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিলেন! অত কিছুর পরেও একজন স্থায়ী গবেষক হিসেবে আমাকে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেননি, যা ছিল চরম অপমানজনক। মেয়েদের প্রতি এই বৈষম্য সেসময় এতটাই প্রকট ছিল। একজন আর কী আশা করতে পারে যদি এই ব্যবহার আসে একজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর কাছ থেকে!” 

আবার আন্নার কথায় ফিরে আসি। আগেই বলেছি রুবি ও হীরকের আলোক-বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডির থিসিস জমা দিয়েছেন আন্না, অপেক্ষায় আছেন ডক্টরেট ডিগ্রি পাবেন বলে। কিন্তু বিধি বাম! আন্নার যেহেতু এমএসসি ডিগ্রি নেই, তাই মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় আন্নাকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে সম্মত হল না। ছ’বছরের নিরলস পরিশ্রম, উচ্চমানের গবেষণা সত্ত্বেও এই বঞ্চনা মুখ বুজে মেনে নিতে হল। সে বছরই পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক অধ্যয়নের জন্য লন্ডনের ইম্পেরিয়েল কলেজে ফেলোশিপ পেলেন আন্না। কিন্তু সেখানে গিয়ে আবহাওয়াবিজ্ঞান এবং যন্ত্র নির্মাণ নিয়ে পড়াশোনা করলেন, হাতে কলমে কাজ শিখলেন। একজন পরিপূর্ণ আবহাওয়াবিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন। 

ইতোমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আন্না ফিরে এসে যোগ দিয়েছেন পুনের আবহাওয়া বিভাগে (Indian Meteorology Department)। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি ‘আবহাওয়া যন্ত্রাদি’ এবং ‘অ্যাটমোস্ফিয়ার-ফিজিক্স’ বিষয়ে অনেকগুলি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেসময় ব্রিটেন থেকে আমদানি করা হত আবহাওয়া সংক্রান্ত যে কোনও যন্ত্রপাতি। আন্না মনি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষ যাতে গবেষণায় স্বনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। প্রথমে রেইন-গেজ, হাইগ্রোগ্রাফ, থার্মোগ্রাফ, ব্যারোগ্রাফস, ব্যারোমিটার এবং অ্যানিমোগ্রাফ ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলি ডিজাইন ও নির্মাণ করলেন। তারপর আবহাওয়া পরিমাপ করার প্রায় একশোটি যন্ত্রের ড্রয়িং ডিজাইন, নির্মাণ এবং মানোন্নয়ন করলেন আন্না। ওই সব সুবেদী যন্ত্রপাতি দিয়ে বায়ুপ্রবাহ, তাপ, চাপ, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা প্রভৃতি প্যারামিটারগুলি মাপা হত। এরই সঙ্গে তিনি সৌর-বিকিরণ সংক্রান্ত তথ্য জানার একাধিক যন্ত্র নির্মাণ করেন। সোলার-এনার্জি সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি তৈরি করে দেশজ গবেষণাকে স্বনির্ভর করে তোলেন আন্না। পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি বিভাগীয় প্রধানে উন্নীত হন। সেসময় তাঁর অধীনে কাজ করত ১২১ জন পুরুষ। 

পঞ্চাশ দশকের শেষে তিনি সৌর-বিকিরণ পরিমাপের জন্য কয়েকটি স্টেশনের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। ব্যাঙ্গালোরে বায়ুর গতি এবং সৌরশক্তির পরিমাপের প্রয়োজনীয় যন্ত্রনির্মাণের একটি ছোট ওয়ার্কশপ স্থাপন করেন। যখন ‘ওজোন স্তর’-এর ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে এদেশে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি, আন্না তখনই বায়ুস্তরের ওজোন মাপার জন্য ‘ওজোনসন্ডি’ নামের যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন! বিক্রম সারাভাইয়ের অনুরোধে থুম্বা রকেট লঞ্চিং স্টেশনে আবহাওয়া-মানমন্দির স্থাপন করেন আন্না। সোলার থারমাল সিস্টেমস সংক্রান্ত  তাঁর রচিত প্রামাণ্য গ্রন্থগুলি সোলার রেডিয়েশন, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক ওজোন এবং উইন্ড এনার্জি সংক্রান্ত প্রভূত মূল্যবান তথ্য জানতে সাহায্য করেছে, যা কিনা মহাকাশ বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, বিমান চালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষের উইন্ড এনার্জি ডেটা যা তিনি ১৯৮৩ সালে প্রকাশ করেন, তা সারা দেশের সাতশোটি বায়ুগতি পরিমাপক কেন্দ্র এবং উইন্ড এনার্জি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তি।


অবসরের পরে তিনি ব্যাঙ্গালোরে রমন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে যুক্ত হন এবং ভারত সরকারের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তি সংক্রান্ত গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আবহাওয়া বিজ্ঞানে একাধিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে পরামর্শদাতারূপে যুক্ত ছিলেন আন্না। একাকী জীবনে কর্মব্যস্ততার বাইরে তাঁর পছন্দ ছিল বই পড়া, গান শোনা, ট্রেকিং ও বার্ড ওয়াচিং। এমন প্রতিভাময়ী নারীর নাম বিস্মৃতির অতলে চলে গেলে তা শুধু আমাদের লজ্জাই নয়, অপরাধও বটে। 




[ পোস্টার : অর্পণ দাস  ]

#বাংলা #বিজ্ঞান #বিজ্ঞান BYনারী #আন্না মনি #সিদ্ধার্থ মজুমদার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

97

Unique Visitors

177760