বইয়ের খবর

বই পোড়ানোর সংস্কৃতি, কামসূত্র ও একটি উপন্যাস

বিবস্বান দত্ত Sep 28, 2021 at 5:01 am বইয়ের খবর

বই: The ascetic of desire
লেখক: সুধীর কাকার
প্রকাশক: পেঙ্গুইন

কামসূত্র নিয়ে সম্প্রতি আমাদের দেশে একটা অতিসংবেদনার আবহ তৈরি হয়েছে। আসলে যে-কোনো মৌলবাদী চিন্তা কাঠামোয় যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা বেশ কিছু অনিবার্য অস্বস্তির জন্ম দেয়। যেখানে অস্বীকৃত হতে থাকে জীবনের সহজ স্বাভাবিকতাগুলি। বই পোড়ানোর সংস্কৃতি এই দেশে তেমন নতুন নয়। এমনকি সারা পৃথিবীর প্রেক্ষিত ধরলেও দেখা যাবে, বিরুদ্ধ মতের প্রচারক গ্রন্থরাজিকে বারবার এনে দাঁড় করানো হয়েছে অগ্নিপরীক্ষায়। এই তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন “কামসূত্র”। ভারতীয় ঐতিহ্যের “পবিত্রতা” বজায় রাখতে উৎসাহী কিছু মানুষের রোষ গিয়ে পড়েছে এই বইটির ওপর। কারণ খুব সহজ। বা ততটা সহজও হয়ত নয়। উগ্র জাতীয়তা খুব সুনিপুণ ভাবেই ইতিহাস পুনর্লিখিত করতে চায়। তৈরি করতে চায় নিজেদের পক্ষে একটা সুবিধাজনক ন্যারেটিভ। আসলে মৌলবাদের সম্প্রসারণের পক্ষে সব থেকে বড়ো বাধা কিন্তু মুক্তশিক্ষা। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ে এক অনিবার্য মগজধোলাইয়ের। আমরা দেখি বিভিন্ন সিলেবাস থেকে কীভাবে ছেঁটে ফেলা হয় কিছু বিশেষ টেক্সট। আমরা দেখি কীভাবে শিক্ষার নামে ধর্মশিক্ষা পাঠক্রমভুক্ত হতে থাকে। আমরা দেখি এক আশ্চর্য প্রত্যাখ্যানের আখ্যান যেখানে খুব সুচতুর ভাবে বুনে দেওয়া হয় এমন কিছু চিন্তার বীজ যা মৌলবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর পক্ষে সুবিধাজনক। হীরক রাজার দেশে হীরকরাজা বলেছিলেন, ওরা যত বেশি জানে তত কম মানে। তাই খানিক ভয় পেয়েই যেন রাষ্ট্র সেইখানে পুড়িয়ে ফেলে উদয়ন পণ্ডিতের পুথিসম্ভার। হীরক রাজের রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রের কালচারাল এবং রিপ্রেসিভ অ্যাপারেটারস এখনও দেশে দেশে সমানভাবে ক্রিয়াশীল।


এই পরিস্থিতিতে হাতে এসে পড়ে এক উপন্যাস। সুধীর কাকারের The Ascetic of Desire। এই উপন্যাস আসলে সেই মানুষটির গল্প যিনি কামসূত্র লিখেছিলেন। এত বছর পর যাঁর বই এক বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের কাছে বিশেষ অস্বস্তির বিষয় হয়ে উঠেছে। লোকটার নাম বাৎস্যায়ন। উত্তর ভারতের কোন এক জায়গায় প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে কোনও এক সময় জন্মেছিলেন তিনি । সময়টা গুপ্তযুগ। যে যুগকে ভারতের সুবর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতিতে ভারতীয় সভ্যতা যখন সাফল্যের চূড়ায়। সেই সময়পটেই কাকার বুনে তুললেন এক আশ্চর্য কাহিনি। যেখানে মূল চরিত্র এক ব্রাহ্মণ ছাত্র। নতুন যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে যে এসে দাঁড়ায় এক অচেনা অনুভূতির সামনে। যার নাম কামনা। বন্ধু চতুরসেন তাকে নিয়ে যায় নগরনটীর কাছে। জীবনের প্রথম যৌন উদযাপন তার সামনে খুলে দেয় এক রহস্যময় প্রদেশের বন্ধ দরজা। এবং সে এও বোঝে, “I knew I had failed her. I wondered what she had felt when we lay intertwined in bed. What is the nature of a woman’s pleasure which should have helped provide”. এইভাবেই কামসূত্রের সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক সংযোগের পরিসর তৈরি হয়। এই উপন্যাসের প্রাথমিক ঘটনাস্থান বারাণসী। সেই সময় সেখানে কামসূত্র পাওয়া খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। ছাত্রটি জানে, “Theory is fundamental”। সুতরাং অক্ষরের দৌত্যে সে পরিচিত হয় বাৎস্যায়নের সঙ্গে। তারপর একদিন হঠাৎ করেই তার কাছে সুযোগ এসে যায় বাৎস্যায়নের চতুষ্পাঠীতে যাওয়ার। এইভাবে এই উপন্যাসও ঢুকে পড়বে বাৎস্যায়নের জীবনঘটনায়। 


তবে এই বই কি বাৎস্যায়নের এক কল্পিত জীবনী? একদম না। এই বই বস্তুত এক মুক্ত সময়ের গল্প বলে যখন যৌনতা ছিল নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশটিকে লুকিয়ে রাখার কোনও প্রয়োজন আছে বলে যে ভারত মনে করত না, এ সেই ভারতের গল্প। যে ভারত মনে করত “The fantasies invented by men is grip of sexual excitement are unimaginable even in dreams” এ সেই ভারতের গল্প। কামনার এক তাত্ত্বিক ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন বাৎস্যায়ন। যৌনতার এক সমাজ রাজনৈতিক চেহারা যে থাকতে পারে, কামসূত্র না থাকলে তা জানতে আমাদের অনেক সময় লেগে যেত। 


এই বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে টাইপের ভুলে এক বন্ধুর কাছে whatsapp এ লিখে ফেলেছিলাম, The aesthetic of desire. কাম-তাপসের জীবন গাথায় যে আশ্চর্য নন্দন রচিত হয়ে রইল এই বইয়ে তাকে হয়ত সেই ভুল-টাইপের মেসেজও এক ভাবে ছুঁয়ে থাকে। এই অসহিষ্ণু সময়ে এই উপন্যাস নিয়ে কথা বলা বেশ বিপজ্জনক সন্দেহ নেই। তবে কথা না বলা মনে হয় আরও বেশি বিপজ্জনক। 



*কৃতজ্ঞতা: এক মদির সন্ধেয় আমার ব্যাগে এই বই ঢুকিয়ে দিয়েছিল শৌভিক। নইলে এই বই পড়া হত না আমার।


আরও পড়ুন: একটা নতুন কবিতার বই/বিবস্বান দত্ত

#The ascetic of desire #সুধীর কাকার #বিবস্বান দত্ত

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

33

Unique Visitors

183185