ফিচার

মিছিলে পা মেলান, তবে মনে রাখুন…

মুনিয়া দেবলীনা Aug 16, 2024 at 8:51 am ফিচার

১৪ই আগস্ট, রাত ৮টা

মেয়েদের রাতের দখল নেওয়ার নানান জমায়েতের মধ্যে একটা ছোট জমায়েতের ব্যবস্থা করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছি আর হোঁচট খাচ্ছি। আমরা বলছি, মেয়েরা ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষরা এই আন্দোলনের সামনে থাকব। কিন্তু আমাদের লিঙ্গপরিচয় মিলে যাচ্ছে বলেই কি সত্যিই কোনও ‘আমরা’ আছে? খুব দূরে যেতে হবে না। কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের চিত্র আমি নিজে গিয়ে দেখিনি। আমি যেটুকু দেখেছি, কলকাতা শহরের মাঝখানে, মধ্যবিত্ত পাড়ার কথা বলছি। তাদের মধ্যে ‘সাধারণ’ মানুষ, যারা কোনোরকম জোরাজুরি ছাড়া, নেহাতই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে এসেছেন। আর বলছি তাঁদের মধ্যেই আরেকটা সামান্য অংশ– কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পড়া লোকেদের, বুদ্ধিজীবীদের, শিল্পীদের, অ্যাক্টিভিস্টদের কথা, যাঁরা এতে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছেন বেশিরভাগ জায়গায়। কোনও পলিটিকাল পার্টির অ্যাজেন্ডা নিয়ে আসা লোকেদের কথা বলছি না। ধরা যাক প্রথম দলের লোকেরা ‘ওরা’ আর দ্বিতীয় দলের লোকেরা ‘আমরা’ (বলা বাহুল্য, স্বল্প কথায় বুঝিয়ে বলার খাতিরে জেনারেলাইজ করছি)। প্রত্যেক হোঁচটে বুঝতে পারি, ওরা আর আমরা আলাদা আলাদা ভাষা বলি। আমরা অনেকেই ওদের ভাষা জানতাম, ছোটবেলা থেকে শিখে বড় হয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে পরে শুধু নতুন ভাষা শিখলাম তা না, পুরোনো ভাষা এমনি ভোলা ভুললাম, যে, কথা বলা অব্দি অসম্ভব হয়ে গেল।

এ এক আশ্চর্য গেরো। যেমন ধরা যাক ‘অ্যাপলিটিকাল’ কথাটা। শুনলেই আমরা তেলে বেগুনে জ্বলে যাচ্ছি। ওঁরা বলছেন, “দেখো বাবা, এর মধ্যে রাজনীতি টেনে এনো না।” আমরা সঙ্গে সঙ্গে নস্যাৎ করে দিচ্ছি। নস্যাৎ করার কারণ, যেটা আমরা বেশিরভাগ সময় বলছিও না, সেটা এই, যে পার্টি পলিটিক্স ছাড়াও রাজনীতি হয়, অধিকারের লড়াই মাত্রেই রাজনৈতিক। আমরা বলতে চাই কোনও রাজনৈতিক দলকে আমরা আজকের জমায়েতে শামিল হতে দিতে চাই না, কারণ তাদের সমস্ত অ্যাজেন্ডার সঙ্গে আমাদের মতে মিলবে না। ওঁরাও একই কথা বলতে চান। কিন্তু যেই অরাজনৈতিক শুনে যেই আমরা ফিক করে হাসছি, কিংবা রেগেমেগে বকে দিচ্ছি, আমাদের মধ্যে বড্ড দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে, আসল কথা বলার জায়গা থাকছে না আর।

আমরা বলছি শঙ্খ বাজাবেন না। যাঁরা জিজ্ঞেস করেছেন, তাঁদের বলেছি, আমাদের পাড়ার জমায়েতে যেন ধর্মীয় রং না লাগে। “সকলে শঙ্খ বাজান”, উদ্যোক্তা হিসেবে এইরকম আমি বলব না। কিন্তু, অনেকেরই বাড়িতে শাঁখ থাকে, হুইসল থাকে না। যাদের মনে হচ্ছে শাঁখ বাজিয়ে তাঁরা তাঁদের পার্টিসিপেশান জানাবেন, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না তাঁরা সকলেই হিন্দু ধর্ম ছাড়া অন্যান্য ধর্মের প্রতি সন্দিহান, অসহিষ্ণু। হ্যাঁ, এইটুকু বলা দরকার ছিল যে শাঁখ বাজানো যেন আমাদের রাত দখলের আন্দোলনের মূল প্রতীক না হয়ে যায়। “যাঁরা বাড়িতে থাকবেন, সবাই শাঁখ বাজান” বললে এইটাও বলা হয়, যে যাদের বাড়িতে শাঁখ থাকে না, তারা বাদ।


আমি শাঁখ বাজাচ্ছি না, কারণ আমার কাছে শাঁখ ধর্মীয় চিহ্ন। কিন্তু আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে ধর্মকে একেবারে বাদ দিতে গেলে অনেক মানুষকে বাদ দিতে হয়। তাদের কাছে শাঁখ, এবং আরও অনেক ধর্মীয় ব্যাপার তাদের রোজকার জীবনের অঙ্গ, কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমদানি করা নয়। কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শাঁখ বাজালে যদি আমরা, বিশেষত নেতৃত্ব দিতে চাওয়া লোকেরা, স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করি, তাহলেও অনেককে বাদ দেওয়া হয়। তাঁরা ভাবেন, “বাবাহ এসব আজকালকার ট্যাঁশ ছেলেমেয়েদের কাণ্ডকারখানায় না ঢোকাই ভালো।” অথচ তাঁদের যদি বুঝিয়ে বলা যায় যে, শাঁখ আপনি ইচ্ছে হলে যেমন বাজাবেন, তেমন আপনার মুসলিম বা খ্রিস্টান (এইখানে বলে রাখা ভালো, কিছু খ্রিস্টানও শাঁখ বাজান) প্রতিবেশী যেন অন্য কোনোভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, সেই দায়িত্বও আপনিই নিন? আপনার দায়িত্ব বেশি, কারণ এখানে আপনি সংখ্যাগুরু। আমার মনে হয় এটা বললে অনেকেই বুঝবেন, অনেকেই সহজে সম্মত হবেন। কিন্তু এই এতখানি কথা গুছিয়ে বলার, শোনার ধৈর্য থাকে না। আমরা বলি, “কেন শাঁখ বাজাচ্ছেন?” ওঁরা ঘাবড়ে যান বা তেড়ে ওঠেন। অনর্থক এই ঝামেলা।

‘সাধারণ’ মহিলাদের জমায়েতে রাগ প্রকাশের মধ্যে অনেকসময় নিষ্ঠুরতা প্রবল। ধর্ষকের ফাঁসি, ক্যাস্ট্রেশান থেকে অ্যাবিউজারের মব লিঞ্চিং-এর দাবি চলে আসছে। যেন ইভটিজার, অ্যাবিউজাররা নৃশংস মনুষ্যেতর প্রাণী– সমাজের শরীরে গলা পচা অংশ মাত্র, কেটে ফেলে পরিষ্কার করে দিলেই আমরা আবার সুস্থ হয়ে যাব। এমন উচ্চশিক্ষিত মানুষের কথা জানি, যাঁরা বলেছেন, যে জমায়েতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের দাবি ওঠে, সে জমায়েতে যাব না। না গিয়ে নিজেকে অনেকটা মানসিক আঘাত থেকে বাঁচানো যায়, সেটাও জরুরি, কিন্তু ওই অব্দিই, আর কোনও লাভ নেই। ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট চাওয়া মানুষদের সঙ্গে যাঁরা ডায়লগেই যেতে চাইছেন না, তাঁরা কি বুঝছেন না যে এই আপাত নিষ্ঠুরতার মধ্যে কতখানি অসহায়তা আছে, ডিনায়াল আছে? বলছি না ফাঁসি চাওয়া লোকেরা সবাই অহিংস ধোয়া তুলসীপাতা, কিন্তু সত্যি সত্যি এঁরা সবাই কারও মৃত্যু কামনা করছেন, তাও আমার মনে হয় না। যদি মেনে নিই যে অ্যাবিউজার-রা ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, আমাদের ঘরের লোক, পাড়ার লোক, ভালোবাসার মানুষ, স্নেহের পাতানো ভাই, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক– একজন বিচ্ছিন্ন মানুষ নয়, অনেকে, অনেকে, তাহলে নিজের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যায় না কি? যদি মেনে নিই যে এদের সমাজ থেকে বাদ দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যাবে না, এ লম্বা লড়াই, আমাদের জীবনকালে শেষ হবে না, যদি মেনে নিই যে, আমরা অনেকসময় কী করব বুঝতে না পেরে বা নিতান্ত অপারগ হয়ে তাদের আড়াল অব্দি করি, তাহলে যে অসীম হতাশার মুখোমুখি হতে হয়, সেই হতাশার সম্মুখীন হওয়া কি সহজ কথা? যাঁরা ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের অসারতা বুঝতে পারছেন, তাঁদের কি দায়িত্ব হয় না, হাতে হাত ধরে এই হতাশার মুখোমুখি দাঁড়ানোর?

সাদা ও জন্মসূত্রে মহিলাদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজম যেমন ফেল করেছে, আমরাও তেমনই ফেল করব, যদি সকলকে সঙ্গে নিয়ে না চলতে পারি, যদি সকলের কথা শোনার ধৈর্য না রাখতে পারি। যেমন ভারতে সংখ্যাগুরু হিসেবে, প্রিভিলেজড হিসেবে, অন্য ধর্মের মানুষদের নিরাপদ রাখার, তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার দায়িত্ব হিন্দুদের বেশি, তেমনই যে মুষ্টিমেয় প্রিভিলেজড মানুষ উচ্চশিক্ষা, ক্রিটিকাল থিঙ্কিং ইত্যাদি বিস্ফোরক ব্যাপারের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছেন, তাদের দায়িত্ব বেশি, ‘জনসাধারণ’-এর ভাষা বোঝার, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার।

সোশ্যাল মিডিয়া প্রবল দরকারি জিনিস, কিন্তু এই যোগাযোগের জায়গা সোশ্যাল মিডিয়া নয়। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় দোষেগুণে একটা গোটা রক্তমাংসের মানুষকে সবসময় দেখা যায় না। তার একটা মত দেখা যায় মাত্র। আমরা সেই মতটা থেকে গোটা মানুষটার একটা অবয়ব তৈরি করে নিই এক মুহূর্তে। “আমি শাঁখ বাজাতে চাই” পড়েই বলে দিই, “ওই এসে গেছে চাড্ডি।” জানি না কী করে, কিন্তু কোনও গণ আন্দোলন সফল করার জন্য আমাদেরও একটু শোনা প্র্যাকটিস করতে হবে। ঠিক ঠিক প্রশ্ন করা প্র্যাকটিস করতে হবে। আর মানুষকে চট করে ডিসমিস করে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

আমি ষোলো বছর বয়েসে ভাবতাম, “কী অসভ্য মেয়ে, অ্যাকাডেমির সামনে শর্ট স্কার্ট পরে ঘুরছে, কোনও মানে হয়!” ভাবতাম শাহরুখ খান বলে দিয়েছে, “প্যার তো এক হি বার হোতা হ্যায়”, সুতরাং সম্পর্ক ধরে রাখতেই হবে, যেভাবেই হোক। ভাবতাম– সচেতনভাবে কারও খারাপ চেয়ে ভাবতাম না, কিন্তু ভাবতাম– “এই কোটা সিস্টেম আমাদের সর্বনাশ করল।” ভাবতাম, “বদ লোকের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা তো আমারই দায়িত্ব, না পারলে আমারই অক্ষমতা।” আমার প্রিভিলেজ, আমি সেরকম মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, সেরকম বই পড়েছি, যাতে একসময় এই ভাবনাগুলোকে নিজেই যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে খণ্ডন করতে পেরেছি। অনেকের সেই প্রিভিলেজ হয়নি। ষোলো বছরের আমার সঙ্গে সবাই ডায়লগ বন্ধ করে দিলে চৌত্রিশের আমি অব্দি পৌঁছোতাম না। তাই এখনও যাঁরা বলেন, “ডিগনিটি নিয়ে চললে কেউ তোমায় হ্যারাস করবে না,” তাঁদের কথা শুনে ক্লান্ত লাগলেও, শুনি, তর্ক করি, যতটা পারি। যারা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট চায় তারা মানুষ না, তাদের আমি কথা বলার যোগ্য মনে করি না, বললে আমায় সারা জীবন একটা প্রগতিশীলদের বানিয়ে নেওয়া পৃথিবীর মধ্যেই থাকতে হবে, যার মধ্যে আবার অনেক মুখোশ পরা লোক, তারা যা বলে তা আসলে বিশ্বাস করে না। ‘সাধারণ’ মানুষদের থেকে তারা অনেক বেশি ক্ষতিকর। আমি তাদের নিয়ে ‘আমরা’ হতে চাই না।

পুনশ্চ- হ্যাঁ, শুধু মধ্যবিত্ত পাড়ার কথাই বলছি, ‘আমাদের’ই পাড়া।





....................

অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান

আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান

                     যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ

                      আমাদের মিছিল/ জুঁই নিয়োগী

                      অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী

                    আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত

                    চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

#We want Justice #R. G. Kar Medical College #reclaim the night #স্পর্ধা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

28

Unique Visitors

213141