বইয়ের খবর

পূর্ণেন্দু পত্রীর কলকাতা

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় Aug 18, 2020 at 9:58 am বইয়ের খবর

ট্রামে - বাসে ভিড়, শ্যামবাজারের কন্ডাক্টরের গলা খ্যাঁকানি, কলেজপাড়ার পুরোনো গন্ধ, লালদিঘির নতুন নাম। এই রোজকার চরম ব্যস্ততায় দিনের শেষে ঘর্মাক্ত শহরটায় যে কেবল ক্লান্তি পড়ে থাকে এ কথা কেউই বলবে না। কলকাতা নামটার মধ্যেই সেই কবে থেকেই জড়িয়ে আছে একটা হুলুস্থুলু ব্যাপার। সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলিকাতা এই তিনটি ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম মিলে যে একটা বিশাল বড় ইতিহাস লিখতে পারে এ আমাদের অহংকার।

গবেষকদের মতে ১৬৯০ সালের ২৪ শে আগস্ট নাকি কলকাতার জন্ম হয়েছিল। যদিও এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। তা সেই ইতিহাস আজও জমে রয়েছে কলকাতার অলিতে গলিতে। যাঁরা সেই ইতিহাস সন্ধানে আগ্রহী তাঁদের রসদের অভাব ঘটার কথা নয়। আছেন শ্রী রথীন মিত্র, হরিপদ ভৌমিক, বিনয় ঘোষ, শ্রীপান্থ প্রমুখ দিকপাল গবেষক-লেখকরা। এঁদের লেখায় যে কলকাতাকে পাই, সে 'বড়োদের কলকাতা'। ঠিক তেমনি, ছোটোরাও যাতে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে পারে গোটা কলকাতাকে, এক দৌড়েই তাদের চেনা হয়ে যায় পুরোনো শহরটাকে,সেই তাগিদ থেকেই কলকাতা নিয়ে কম করে গোটা আষ্টেক বই লিখেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী।

কলকাতার রাজকাহিনী,পুরনো কলকাতার পড়াশোনা, ছড়ায় মোড়া কলকাতা, কী করে কলকাতা হলো, এক যে ছিল কলকাতা, জোব চার্নক যে কলকাতায় এসেছিলেন, কলকাতার গল্পসল্প, কলকাতার প্রথম।

ছোটো ছোটো বইয়ের গুচ্ছ হলেও এই বইগুলি কিন্তু কেবলমাত্র ছোটদের জন্যে নয় মোটেই। কলকাতা বিষয়ক গবেষকদেরও তারা বিন্দুমাত্র নিরাশ করে না। আর পূর্ণেন্দু পত্রীর কলমের জাদু পাঠককে টেনে রাখে বইয়ের শেষ পর্যন্ত। এই বইগুলিতে আছে সাবলীল ভঙ্গিতে হালকা ছন্দে বহু তথ্য একসঙ্গে পরিবেশন করার একটা ধরন। যা তথ্যভারে কখনোই ক্লান্ত করে না, বরং বাড়ায় ঔৎসুক্য। প্রতিটা বই একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা। সেই বিষয়ে তথ্য, ঘটনা সমস্ত কিছুকেই পূর্ণেন্দু এক চমৎকার গল্প বলার ঢঙে শুনিয়ে যান পাঠককে। অনেক লেখাতেই পলাশীর যুদ্ধের আগে এবং পরে বলে সময়কাল বুঝিয়েছেন তিনি। তথ্যের মাঝে আছে কলকাতার অনেক ছোটো ছোটো গল্প, যা অজানাই থেকে যাবে এ বইগুলি না পড়লে।

যেমন ধরা যাক, রাজা রামমোহন রায়ের মাথার পাগড়িটা আজও রাখা আছে, কারণ সে পাগড়ির মাপের মাথা নাকি আজও কলকাতা শহরে আর একটিও পাওয়া যায়নি। কলকাতাকে নিয়ে হরেক রকম ছড়া বহুলপ্রচলিত। কিন্তু সে ছড়ার পিছনে আছে হরেক রকম ইতিহাসও।

" রেতে মশা দিনে মাছি
এই নিয়ে কলকেতায় আছি "

এ ছড়া তো মুখে মুখে ফেরে আমাদের। এর পিছনে আছে এক গল্প। ক্যাপ্টেন হ্যামিল্টন সাহেবের হিসেব অনুযায়ী ১৭০০ সালে কলকাতার সাহেবের সংখ্যা ছিল ১২০০। এক বছরে পাক্কা জ্বরে মারা যায় ৪৬০ জন। সেখানেই এই কবিতার এক সত্যি ইতিহাস গড়ে ওঠে।

আছে কলকাতার পড়াশোনার গল্প। আছে শিক্ষকদের গল্প। পড়াশোনার সঙ্গে ফাঁকি শব্দটা তো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। তাই 'পুরনো কলকাতার পড়াশোনা'য় আমরা পেয়ে যাই ইস্কুল পালানো ছাত্রদের গল্প। সেই তালিকায় আরও অনেকের সঙ্গে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তবে তিনি তখন মোটেও সাহিত্যসম্রাট নন, একজন পাঠশালা পালানো ছাত্র। যিনি পাঠশালায় যেতেন, কিন্তু পড়াশোনা করতে নয়, গুরুমশাইয়ের বদলে হাতে বেত নিয়ে অন্যান্য ছাত্রদের শাস্তি দেবার ভার তিনি নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন। যারা যারা বালক বঙ্কিমের সঙ্গে আগের দিন তাস খেলতে যেত না, পরের দিন তাদের কপালেই জুটত সেই বেতের আঘাত।

আবার কেবলমাত্র ছাত্র নয়, পেয়ে যাই শিক্ষকদের এমন কিছু মজার মজার গল্প, যা পড়ার ফাঁকে অজান্তেই আমাদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। হেয়ার সাহেবের নাম তো আমরা সবাই জানি। মস্ত বড়ো মানুষ। কিন্তু তিনি যে একদিন ভূত সেজে ছাত্রদের ভয় দেখিয়েছিলেন কেবল তাদের প্রাইজ দেওয়ার ভয়ে, এ গল্প জানাই হত না 'পুরনো কলকাতার পড়াশোনা' না পড়লে। কিন্তু ছাত্ররা তো চিরকালই দুষ্টু। তারাও নাছোড়বান্দা। তারা তাদের ক্লাসে পড়া পারার প্রাইজ হিসেবে একটি করে বই হেয়ার সাহেবের কাছ থেকে আদায় করেই ছাড়ে। এসবের কাণ্ডারী ছিলেন হেয়ার সাহেবেরই এক ছাত্র ভূদেব মুখোপাধ্যায়। ছাত্র যতই দুষ্টু হোক, শিক্ষকের স্নেহ সব সময়েই তাদের জড়িয়ে রাখে। তাই এতসব হওয়ার পরেও যখন সেদিন ছাত্র ভূদেব মুখোপাধ্যায় রাতেরবেলা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, হঠাৎই টের পান তাঁর পিছনে আরও কেউ আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই সেই চমক ভাঙে। তিনি আর কেউ নন, সেই হেয়ার সাহেব, একটু আগেই যিনি ছিলেন এঁদের প্রতিপক্ষ। ছাত্র ঠিকমতো অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারল কি না তা দেখার দায়িত্ব তো একজন শিক্ষকেরই। তাই না?

'কী করে কলকাতা হল' পড়ে জানতে পারি প্রথম 'লটারি খেলা'-র ব্যবস্থা করেন লর্ড হেস্টিংস। সেই খেলার টাকা থেকেই হয় টাউন হল, কলেজ স্ট্রিট, স্ট্র‍্যান্ড রোড। কলকাতার প্রথম ধর্মঘট হল ১৮২৭ সালের পালকি ধর্মঘট । সে নিয়ে আছে যেমন বহু আলোচনা, তেমনই সেখানে মিশে আছে বেশ কিছু মজার ঘটনা। যেমন ক্লিভল্যান্ড সাহেবের প্রথম পালকি চড়ার অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশের পালকি বেয়ারাদের গান শুনে উনি ভাবলেন এ বুঝি তাদের প্রচণ্ড কষ্টের গোঙানি। মনুষ্য হত্যার পাপের ভাগী হবেন তিনি, এই ভেবে পালকি থেকে নেমে তাদের একটাকা করে দিয়ে তিনি নিস্তার পেলেন।

দোলের দিন লালদিঘির জলে রং গুলে সেই জল পিচকারিতে ভরে রং খেলা হত। সেই থেকেই নাকি এর নাম হয় লালদিঘি। 'কলকাতার গল্পসল্প' থেকে জানতে পারি তখনকার বাবুদের আতরের লড়াই, হিসেবের লড়াই, বুলবুলির লড়াইয়ের কাহিনি।

'কলকাতার প্রথম '-এ আছে প্রথম বই, প্রথম বাগান, নবগোপাল মিত্রের প্রথম সার্কাস 'ন্যাশনাল সার্কাস' ইত্যাদির কথা।

পূর্ণেন্দু পত্রীর এই আটটি বই-ই কলকাতার এক একটা দিকের সামগ্রিক চেহারা। এই বিষয়ের আগ্রহীদের তেষ্টা মেটানোর জন্যে উপযুক্ত ।

আর এই সবকটা বই-ই আজ সহজলভ্য। বাড়ির পাশের লাইব্রেরিতে অনায়াসেই পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও এর মধ্যে বেশ কিছু বই দেজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাই আর দেরি করা মোটেই উচিত হবে না। কলকাতার জন্মদিনের আগে কলকাতা নিয়ে আরেকটু জেনে নিলে ক্ষতি কী!



[পোস্টার : অর্পণ দাস।]

#পূর্ণেন্দু পত্রী #কলকাতা #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় #বইয়ের খবর #বুক রিভিউ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

183402