উপন্যাস

আখ্যানের খোঁজ (চতুর্থ পর্ব)

বিবস্বান May 25, 2024 at 9:06 pm উপন্যাস

(তৃতীয় পর্বের পর)

..................

দশমীর সন্ধে। আখ্যান চুপ করে বসে আছে বাগবাজার ঘাটের থেকে খানিক দূরে। এক দাদা নেমন্তন্ন করেছিল বিজয়ায়। আখ্যান যেতে পারেনি। দাদা খুব রাগ করেছে স্বভাবতই। কিন্তু কী করবে আখ্যান? এই পুজোয় সে একের পর এক প্ল্যান ক্যান্সেল করেই চলেছে। কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারছে না তার নতুন চাকরির কথা। সারাদিন কেটে যাচ্ছে ভিড়ে ঠাসা কলকাতায় ওই নির্দিষ্ট ঘরটা খুঁজে খুঁজে। 

হঠাৎ কোথা থেকে আখ্যানের পায়ের কাছে এসে পড়ল একটা নীলকণ্ঠ পাখির পালক। পেছন থেকে চুপ করে আখ্যানের পাশে এসে বসে মাধবী।

কি রে? দমে গেলি নাকি?

নাহ। আসলে সবাই ভুল বুঝছে।

মাধবীর গলায় চিরকালই খুব সুর। ও গেয়ে উঠল, যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কী আসে যায়…

মান্না দে। নিশিপদ্ম ছবির গান। কিন্তু আমার আসে যায়। 

জানিস, আমি যে জঙ্গলে থাকতাম, সেইখানে মাঝেমধ্যেই আমার মনখারাপ হত। তোদের থেকে দূরে। চেনা বলতে কেউ নেই। শুধু কয়েকটা অনেক অনেক পুরোনো বটগাছ। সময়ের জটিল ঝুরি নেমে এসেছে তাদের শরীর থেকে। আর একটা দিঘি। পাশ দিয়ে কত লতা, পাতা, নাম না জানা ফুল। আমার মনখারাপ হত যে রাতগুলোয়, ঠিক সেই রাতগুলোতেই এই দিঘিতে নিশিপদ্ম ফুটত। তারপর একদিন আমার খুব মনখারাপ হল। পুরো দিঘিটা ভরে গেল নিশিপদ্মে। আর দিঘির পাশের ছাতিম গাছটায় অনেক ফুল ফুটে উঠল। সে কী গন্ধ! আমি আর থাকতে পারলাম না। 

তাই এলি?

ঠিক তা নয়। আমার আসতে ইচ্ছে করল। তবে আর বেশিদিন নয়। চলে যাওয়ার সময় এসেছে আমার। এই দেখ না, গালে সিঁদুর লেগেছে!

সে তো মাঠে ওরা সিঁদুর খেলছিল। তোকে লাগিয়ে দিল বলে। 

হ্যাঁ। লাগিয়ে দিল। অমনি ঢাকিরা ঢাক বাজাল। অমনি কোথা থেকে একগাদা ধুনুচির ধোঁয়া এসে দমবন্ধ করে দিল। আর তা ছাড়া তোর কাজটাও এইবার মিটে যাবে। আমি বুঝতে পারছি।

কীভাবে মিটবে! কোনও খবরই তো পেলাম না। 

খবর আসবে। বলেই পায়ের কাছ থেকে নীলকণ্ঠ পাখির পালকটা তুলে নিয়ে মাধবী নদীতে ভাসিয়ে দিল। 

সেই পালকটা, জলের ধাক্কায় আস্তে আস্তে ভেসে গেল দূরে। দুখানা প্রদীপ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। তাদের দিকে এগিয়ে গেল নীলকণ্ঠ পাখির পালক। খানিক দূরে একটা হল্লা উঠল! বলো দুর্গা মাই কি… ঝপাং করে শব্দ। জলে ঠাকুর পড়ল। 

ঠিক এই সময় যযাতি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। সমস্ত মনখারাপ হাওয়ায় ছড়িয়ে গেছে শিমুল তুলোর মতো। প্রচণ্ড ঢাক বাজছে চারদিকে। একের পর এক ঠাকুর ভাসানে বেরিয়েছে। সঙ্গে উত্তাল নাচ। যযাতি একটু ফাঁকা একটা গলিতে ঢুকে পড়লেন। কলকাতার দু-একটা গলিতে সারা বছর কুয়াশা থাকে। এইটা সেইরকম একটা গলি। আস্তে আস্তে যযাতি মিলিয়ে যেতে থাকলেন সেই কুয়াশায়। কাল রাতেই ওঁর পায়ের কাছে কে যেন একটা নীলকণ্ঠ পাখির পালক রেখে গেছে। 

যযাতির শরীরে উঠে এল পট্টবস্ত্র। যযাতি আবির্ভূত হলেন এক অতিপুরাতন দুর্গামণ্ডপে। চতুর্দিকে রোশনাই। লালপাড়ের গরদ পরা মেয়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন সাশ্রুনেত্রে। ঢাকে বেজে উঠছে বিসর্জনের বাজনা। যযাতির মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, 

“ওঁ গচ্ছ গচ্ছ পরং স্থানং স্বস্থানং পরমেশ্বরি। 

যত্র ব্রহ্মাদয়ো দেবাঃ ন বিদুঃ পরমংপদম্।। 

উত্তিষ্ঠ দেবি চামুণ্ডে শুভাং পূজাং প্রগৃহ্য চ।

কুরুষ্ব মম কল্যাণং অষ্ঠাভিঃ শক্তিভিঃ সহ।।

দুর্গে দেবি জগন্মাতঃ স্বস্থানং সুরপূজিতে।

সংবৎসর ব্যতীতে তু পুনরাগময় চ।।”

মাধবী হেঁটে যাচ্ছে জলের ওপর। তার পায়ের সামনে একটা নীলকণ্ঠ পাখির পালক। দুপাশে দুটো প্রদীপ। মাধবী চিৎকার করে বলছে, আমি আর কোনও দিন ফিরব না বাবাআআআ…। এই পৃথিবীর সমস্ত ঢাক বন্ধ হয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে কোথাও কোনও শব্দ নেই। কোথাও কোনও আলো নেই। শুধু জলের ওপর, যেখানে কুয়াশা ঘন হয়ে আছে সেইখানে ভাসমান দুটো আলো। আর একটা কানফাটানো চিৎকার। আমি আর কোনওওও দিন…।


শরৎকালে কোনও দিন কোনও যুদ্ধ হয়নি। শরৎকালে যুদ্ধ হয় না। তবু শরৎ ঋতুতেই ফিরে ফিরে আসে বিজয়া। কেন? এ কার জয়? প্রাচীনকালে শরৎ ঋতুতে বর্ষ আরম্ভ হত। সময়ের সেই হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায়, প্রার্থনা ছিল, জীবেম শরদঃ শতম্। বিজয়া দশমী সেই শারদবর্ষের প্রথম দিন। দশমীর উৎসব বস্তুত নববর্ষোৎসব। নতুন বছরে আমাদের জয় হোক, এই প্রার্থনা লুকিয়ে থাকে বিজয়ার উৎসবে। বৈশাখের নববর্ষ বণিক নববর্ষ। কিন্তু কোনও এক হারিয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডারে আজকেই বছরের প্রথম দিন। 

এইরকম কত ক্যালেন্ডার হারিয়ে ফেলেছি আমরা। হারিয়ে ফেলেছি কত পঞ্জিকা। সেই কোনও এক ক্যালেন্ডারের পাতায় ঢুকে পড়েছেন যযাতি। ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে ঠাকুরদালান। আর আর-এক ক্যালেন্ডারে শুধু নৈঃশব্দ‍্য। একটা নদী। ওপরে জমাট কুয়াশা। দুটো প্রদীপ পাশে নিয়ে জলের ওপরে হেঁটে যাচ্ছে এক মেয়ে। আর অন্য কোনও ক্যালেন্ডারে একটা আলো-কোলাহলভরা গঙ্গার ঘাটে বসে আছে আমাদের আখ্যান। 

তার সন্ধান এখনও জারি। 



দশমীর পর ঠিক সাড়ে তিনদিন কেটে গেছে। এই সাড়ে তিনদিনে একদম চুপ করে গেছে আমাদের আখ্যান। দশমীতে মাধবী চলে গেল। তারপর সেই আশ্চর্য ঘর খোঁজার ইচ্ছেটাও চলে গেল আখ্যানের। একাদশীর দিন মাধবীর ফ্লাইট। আখ্যান এয়ারপোর্ট থেকে খুব বেশি দূরে থাকে না। কিন্তু সে মাধবীকে সি অফ করতে যায়নি। মনখারাপ করে সারাদিন বাড়িতে বসে রইল। আর সেই দিন থেকেই ঘুম জিনিসটা একেবারে চলে গেল আখ্যানের। সারারাত প্যাঁচার মতো তাকিয়ে থাকা। প্রচণ্ড একঘেয়ে বিছানায় খানিক ছটফট করতে করতে বারবার জল খেতে ওঠা। তারপর শেষ রাতের প্রথম পাখির ডাক। ঠিক সাড়ে তিনদিন না ঘুমিয়ে আখ্যান বুঝতে পারল, বিষয়টা ঠিক হচ্ছে না। এইভাবে চলতে থাকলে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাকে আবার সেই ঘরটা খুঁজতে বেরোতেই হবে। না হলে তার আর কোনও দিন ঘুম আসবে না। 

এমনিতে সারাদিন ঘরে বসে থাকলে মানুষের শরীর পাথর হয়ে যায়। ভীষণ ভারী। আর কে না জানে, পাথরদের কোনও দিন ঘুম আসে না। তাই আখ্যান ঠিক করল, এইবার থেকে ও রোজ বেরোবে। রোজ একটু না বেরোলে আখ্যান আর পারছে না। এদিকে বন্ধুবান্ধব তেমন নেই ওর। কোনও দিনও ছিল না বিশেষ। চিরকাল আখ্যানের নিজেকে জিগ’স পাজলের বাক্সে ভুল করে দিয়ে দেওয়া একটা অতিরিক্ত টুকরো মনে হয়। যে টুকরোটা ওই পাজলের কোনও অংশেই ফিট করে না। হয়তো অন্য কোনও পাজলের অংশ সে। সৃষ্টিকর্তার ভুলে চলে এসেছে আরেক পাজলের বাক্সে। ওর জন্য এই পৃথিবীর অথবা অন্য কোনও পৃথিবীর কোনও না কোনও জিগ’স পাজল অসম্পূর্ণ হয়ে আছে। কিন্তু খাপে খাপ বসে যাওয়ার সেই ঠিকানা আখ্যানের অজানা। আর এই জিগ’স পাজলের কোনও জায়গাতেই আখ্যান নিজেকে ঠিক মেলাতে পারছে না। 

বন্ধু নেই। ফলে বন্ধুদের আড্ডাও নেই আখ্যানের জীবনে। বিকেলবেলার রোয়াক নেই। চায়ের ঠেক নেই। সন্ধের ক্যারাম নেই। শীতরাতের ব্যাডমিন্টন নেই। ভেবে দেখতে গেলে ওই ঘরটা খোঁজা ছাড়া আখ্যানের বেরোনোর আর কোনও কারণ নেই। সুতরাং বেরোতে যখন হবে তখন ঘরটা খোঁজাই ভালো।

না খুঁজলে এমনিতে কোনও ক্ষতি নেই। শুধু ঘুম আসছে না। আর অন্ধকারের ভেতর থেকে কয়েক জোড়া চোখ খুব রেগে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছু বলছে না যদিও। তাই এই অস্বস্তিজনক পরিস্থিতি কাটানোর জন্য আখ্যান আবার ঘরটা খোঁজার সিদ্ধান্তই নিল। মাধবী বলেছিল আখ্যান খুব শিগগিরই একটা খবর পাবে। কী খবর, কোথা থেকে সেই খবর আসবে, এইসব কিছুই জানে না আখ্যান। তবে বাড়ি বসে খবরটার অপেক্ষা করার আর মানে হয় না। বরং আবার নিজের মতো খুঁজে দেখা যাক। এই ভেবে আখ্যান বেরোল। 

বেরোনোর মুখেই ভীষণ অবাক হয়ে গেল আখ্যান। বাড়ির নিচের লেটারবক্সে সাধারণত ইলেকট্রিকের বিল আর বিজ্ঞাপনের কাগজ ছাড়া অন্য কিছু আসে না। সেই চিঠির বাক্স থেকে উঁকি মারছে একটা সাদা খাম। গায়ে ডাকটিকিট। মুখ বন্ধ। খুবই অবাক হয়ে গিয়ে আখ্যান চিঠিটা বের করে নিল। 

পাঞ্জাবির পকেটে চিঠিটা নিয়ে আখ্যান হাঁটা লাগাল তার নিজস্ব পাড়াটার বুক চিরে। যদিও নিজের, তবু আখ্যানের মনে হয় সে এই পাড়ার কাউকেই চেনে না। এই পাড়ার সবাই এমন এক আশ্চর্য ভাষায় কথা বলে, যে ভাষা আখ্যান বোঝে না। আবার উলটোটাও তো মিথ্যে নয়। আখ্যানের ভাষাও এই পাড়ার কেউই তেমন বুঝতে পারে না। তবু বিকেল হলে এই পাড়াটার পেটের মধ্যে দিয়ে এক বৃদ্ধ অজগর সাপের মতো হাঁটতে থাকে আখ্যান। পশ্চিমের মোটর মেশিনারি কারখানার ওপার দিয়ে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। 

ছোটো থেকেই এই কারখানাটা দেখছে আখ্যান। তার জন্মের অনেক আগে, কোনও দিন এইখানে ছিল শহরের প্রথম মোটর পার্টস তৈরির কারখানা। তারপর সেইখানে তালা পড়ে যায়। বিশাল জায়গা। অথচ প্রচুর শরিক। অনেকদিন থেকে মালিকানা নিয়ে মামলা চলছে। এইদিকে কারখানা জুড়ে তৈরি হয়েছে একটা জঙ্গল। পাড়ার হারিয়ে যাওয়া সমস্ত পাখি গিয়ে লুকিয়েছে সেই জঙ্গলে। বিশাল দেওয়ালের ওইপারে এখন পাখিদের শহর। গেটে নোটিশের পর নোটিশ ঝুলিয়ে দেয় আদালত। আর গেটের ভেতরে পাখিদের শহরে রোজ নতুন নতুন পরিবার যোগ দেয়। 

সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার দিকেই হেঁটে গেল আখ্যান। পাঁচিলের গায়ে একটা নির্জন মতো বসার জায়গা পেয়ে পকেট থেকে চিঠিটা বের করে নিল। আঠা দিয়ে আটকানো চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে হল পড়ার জন্য। 

না। ঘরের খবর নেই সেখানে। আছে একটা বই। যে বই আখ্যান নিজে অনেক ভেবেচিন্তে কিনেছিল কলেজ স্ট্রিট থেকে। লেখিকা ভদ্রমহিলা প্রথমে প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন। তারপর জেএনইউ। লেখাটা উপন্যাস। তবে ইতিহাস সেই উপন্যাসের মস্ত এক চরিত্র। 

আখ্যান বিশেষ করে এই বইটা কিনেছিল এক ইতিহাসবিদের জন্য। অল্প কয়েকদিনের আলাপে তিনি চমৎকার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মধ্যযুগীয় কোর্টলি লাভের ইতিবৃত্ত। কেন ত্রিস্তান-ইসল্টের গল্পকে নিছক পরকীয়া প্রেম দিয়ে পড়া যাবে না, কেন তার সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হয় মধ্যযুগীয় নাইটদের ইতিহাস, এই সবই খুব সোজা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তিনিও প্রথমে প্রেসিডেন্সি, তারপর জেএনইউ। এইসবের জন্যই খুব চিন্তাভাবনা করে আখ্যান পছন্দ করেছিল তাঁর ফেয়ারওয়েল গিফট। কিন্তু কিছু উপহার থাকে যেগুলো আর কোনও দিনই দিয়ে ওঠা হয় না। অন্য শহরের সেই ইতিহাসবিদকে ফিরে যেতে হয়েছিল। আখ্যানেরও সেই বই আর তাঁকে দিয়ে ওঠা হয়নি। তারপর একদিন বইটা হারিয়ে গেল।

সেই হারিয়ে যাওয়া বই আবার অন্য কারও উপহার হয়ে ফিরে এসেছে তার কাছে। কিন্তু কে পাঠাল এই বই? ভাবতে ভাবতেই বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানায় ঘণ্টা বেজে উঠল। সমস্ত পাখিরা খুব ব্যস্ত হয়ে ফিরতে লাগল নিজের শহরে। সন্ধে আর বিকেলের মাঝখানের গলিপথটা খুলে গেল।

.................. 

কৃতজ্ঞতা : বিজয়া, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, সমকালীন পত্রিকা ১৩৭৬ অগ্রহায়ণ 

কালিকা-পুরাণীয় দুর্গাপূজা পদ্ধতি, গণপতি বিদ্যারত্ন ও আশুতোষ তর্কতীর্থ

[ক্রমশ] 

.................

আগের পর্ব পড়ুন : আখ্যানের খোঁজ (তৃতীয় পর্ব) 

পরের পর্ব পড়ুন : আখ্যানের খোঁজ (পঞ্চম পর্ব) 


[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র] 



#উপন্যাস #বাংলা উপন্যাস #ধারাবাহিক উপন্যাস #আখ্যানের খোঁজ #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

53

Unique Visitors

217960