বাবার খাবারে লুকিয়ে আছে সন্তানের বিপদ
তেলে আর ঝোলে, রসনার কোলে বাঙালি হৃদয় তৃপ্ত। ব্যাঙ্কে সঞ্চয় একটু কম হলেও চলে, কিন্তু পাতে চর্ব্য-চোষ্য কম হলে আমাদের রবিবাসরীয় মেজাজের দফারফা হয়ে যায়। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, শুধু রবিবারই নয়, অফিস-ফেরত চপ-রোল-চাউমিনের দৌলতে দৈনন্দিন ডায়েটে চর্বির পরিমাণ ভালোই। নিয়মিত কায়িক শ্রমের তোয়াক্কা না করলে অচিরেই সে চর্বির আধারকার্ডে ঠিকানা লেখা হয় মধ্যপ্রদেশ। অবশ্য গুরুজনেরা বলেন, নোয়াপাতি ভুঁড়ি পুরুষের সুখের লক্ষণ। মুশকিল হল, সে সুখ যে আদতে সন্তানের অসুখের কারণ হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের কেউ সাবধান করেনি। সমস্যাটা একা বাঙালির নয়, সব পুরুষের। এতদিন জানা ছিল গর্ভাবস্থায় মায়েদের শারীরিক সুস্থতা ও খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব পড়ে সদ্যোজাতের উপর, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবারে অভ্যস্ত বাবাদের থেকেই মধুমেহ রোগের বীজ ছেলের শরীরে বাসা বাঁধে!
ঘটনার সূত্রপাত কয়েক বছর আগে, ২০১৬ সালে। আমেরিকার উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজননবিদ্যার গবেষক কি চেন (Qi Chen) ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখিয়েছিলেন, বিপাকক্রিয়ার গোলমাল নিয়ে জন্মানোর জন্য অতিরিক্ত চর্বি-চেবানো বাবা ইঁদুরের শুক্রাণুটুকুই যথেষ্ট, মা ইঁদুরের ছিমছাম খাদ্যাভ্যাসেও সে ক্ষতি আটকানো যায় না। এমনকি পুষ্টিকর ডায়েট চার্ট মেনে চলা ইঁদুর দম্পতির মিলনে যে ভ্রূণের জন্ম, তার মধ্যে যদি কোনোভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় হাই ফ্যাট ডায়েটে অভ্যস্ত ইঁদুরের শুক্রাণুর আরএনএ (RNA), তাহলেও সেই ভ্রূণজাত সন্তানের কপাল, থুড়ি, পেট মন্দ! শর্করাজাতীয় খাদ্যের পাচনক্রিয়ার কোনও না কোনও গোলমাল তার নিত্যসঙ্গী হবেই। শুনে একটু আজব ঠেকলেও ব্যাপারটা নেহাত মিথ্যে নয়। বহু বছরের গবেষণায় এটুকু পরিষ্কার, আমাদের খাদ্যাভ্যাসের বদল ঘটলে শরীরের কোশগুলিও সেই বুঝে খাবার হজম করার জন্য লেগেপড়ে থাকা জিনগুলির সক্রিয়তা বাড়ায়-কমায়। জেনেটিক বদল, অর্থাৎ ডিএনএ (DNA)-তে রাতারাতি পরিবর্তন ঘটানো অত সহজ নয়, তাই বদলটা ঘটে তার দোসর আরএনএ-তে। দ্বিতন্ত্রী ডিএনএ-এর মতো একতন্ত্রী আরএনএ-রও আছে নিজস্ব সংকেত, সেই সংকেতের ঘাড়ে কিছু রাসায়নিক অণু চেপে বসলেই তার কার্যকারিতা পাল্টে যায়। একে বলে “এপিজেনেটিক” পরিবর্তন, অর্থাৎ পরিবেশের প্রভাবে জিনের চরিত্র বদল। কি চেনের কাজেও এটাই দেখা গেছে – হাই ফ্যাট ডায়েটে অভ্যস্ত পুরুষ ইঁদুরের শুক্রাণুর মধ্যে এক বিশেষ প্রকার আরএনএ এই ধরনের খাবার হজমের সংকেত বয়ে চলে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কচি ইঁদুর যেমনই খাবার খাক না কেন, তার শরীর তো বাপের নির্দেশে আগেভাগেই তৈরি হয়েছে অতিরিক্ত চর্বি ভাঙ্গতে। সেই অতি উৎসাহের ফলে হজমের প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই গোলমাল।
বেশ তো! রোগ হচ্ছে ইঁদুরে, তা নিয়ে আমাদের খামোখা মাথাব্যথা কেন? কারণ এই বছরের জুন মাসে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, বিপদটা মানুষের মধ্যেও দিব্যি আছে, এতদিন শুধু জানতে পারা যায়নি। উল্লিখিত গবেষণার মূল হোতা, ‘জার্মান সেন্টার ফর ডায়াবেটিস রিসার্চ’-এর বিজ্ঞানী রাফায়েল তেপেরিনো ও তাঁর সহকর্মীরা বলছেন, পুরুষমানুষের স্থূলত্বের সঙ্গে তার সন্তানের ডায়াবেটিস বা অন্যান্য বিপাকীয় গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনার বেশ মাখোমাখো সম্পর্ক আছে। তাঁরা আসলে কি চেনের কাজের সূত্র ধরেই আরও একটু এগোচ্ছিলেন, পথের মাঝে দেখেন বাবা ইঁদুরের খাদ্যাভ্যাস আসলে শুক্রাণুর পরিণত হয়ে ওঠার পদ্ধতিতেই প্রভাব ফেলছে। আরও খতিয়ে দেখে তাঁরা বুঝলেন, প্রভাবটা ডিএনএ-আরএনএর আঁতুড়ঘর নিউক্লিয়াসে নয়, বরং মাইটোকন্ড্রিয়ায়! সেই স্কুলে পড়া লাইফ সায়েন্স বইতে লেখা থাকত, “মাইটোকন্ড্রিয়া হল কোশের শক্তির উৎস”, সেই উৎস এমন উদ্ভট আচরণ করবে কেন? তার থেকেও বড়ো ধাঁধা, শুক্রাণু থেকে শুধু নিউক্লিয়াসটিই ডিম্বাণুর মধ্যে ঢোকে, যে কারণে সমস্ত জীবের ভ্রূণের মাইটোকন্ড্রিয়াটি আসলে মায়ের দান; তাহলে শুক্রাণুর মাইটোকন্ড্রিয়ায় কি হল না হল, তাতে ভ্রূণের কী যায় আসে?
অনেক কিছুই যে যায়-আসে তার কারণ ওই স্কুলে শেখা বাক্যটিই। একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার লক্ষ্যে ছুটে যায় হাজার হাজার শুক্রাণু, আপনি-আমি সবাই তো প্রতিযোগিতার ফসল। তা এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে গেলে এক দমে বাকিদের টপকে যেতে হবে, আর তার জন্য চাই প্রভূত শক্তির জোগান। যা দেবে সেই মাইটোকন্ড্রিয়া। এদিকে মাইটোকন্ড্রিয়ার ধরনধারণ অনেকটা যেন কোশের মধ্যেই আরেক ক্ষুদ্র কোশ, তার নিজস্ব ডিএনএ-আরএনএ আছে, তাই দিয়ে সে শক্তির রান্না চাপায়। কিন্তু রোজকার পুষ্টির কুটনো কুটতে গিয়ে বেচারা মাইটোকন্ড্রিয়ার আরএনএ-গুলোর ষষ্ঠীপুজো হয়ে যায়। তারা ভেঙ্গেচুরে তৈরি করে ছোট্টো ছোট্টো আরএনএ তন্তু, যা অতি সহজেই শুক্রাণুর নিউক্লিয়াসের পিছন-পিছন ডিম্বাণুতে ঢুকে পড়ে। এহেন অবস্থায় যে পুরুষ জমিয়ে তেলচর্বির শ্রাদ্ধ করছে, তার শুক্রাণুদের উসেইন বোল্ট বানানোর জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াও তেড়েফুঁড়ে ওই চর্বি থেকেই শক্তি রাঁধতে বসছে। ফলে ভাঙ্গা আরএনএ-তে ছাপ থেকে যাচ্ছে সেই রান্নার রেসিপির। সেই আরএনএ-র নির্দেশেই ভ্রূণের মধ্যে বাসা বাঁধছে গ্লুকোজ ইনটলারেন্স বা ডায়াবেটিসের মতো রোগ।
ইঁদুরে গবেষণা চালাতে গিয়েই তেপেরিনো দেখেছিলেন, এই ঘনঘটার ফলে ভ্রূণের যেসব জিন অতিসক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়, সেগুলো মানুষের মধ্যেও একইভাবে কাজ করে। উনিশ থেকে একুশ বছর বয়সী ১৮ জন মানুষের উপর পরীক্ষা চালিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, বাবা যত মোটা হবেন, তাঁর মাইটোকন্ড্রিয়া-জাত আরএনএ নিয়ে ছেলের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ততই বেশি। আজ্ঞে হ্যাঁ, পুত্রসন্তানের উপরেই কোপটা পড়ে। তেপেরিনো এবং চেন, দুজনের কাজেই দেখা গেছে যে ইঁদুরের ক্ষেত্রেও রোগের বীজ বাবা থেকে ছেলের দিকেই ধায়। অতএব সুপুত্রের সুস্বাস্থ্য চাইলে আজকেই ডায়েটের দিকে নজর দিন। এই গবেষণা আমার-আপনার বোধ জাগানোর জন্যই। নাহলে ইঁদুররা তো এসব আগের থেকেই জানত, সাধে কি আর রুপোলি পর্দার মাস্টারশেফ ইঁদুর চিজ-মেয়োনিজ ছেড়ে টমেটো-পেয়াঁজ-বেগুন দিয়ে র্যাটাটুই রাঁধতে গেছিল!
তথ্যসূত্র :
1. https://www.nature.com/articles/s41586-024-07472-3
2. https://www.science.org/doi/10.1126/science.aad7977
......................
#acquired metabolic disorder #intergenerational inheritance #pop science