বইয়ের খবর

সন্তজীবনের ফুল আর মানুষজীবনের কাঁটা : ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'আলোর মানুষ'

রোহন রায় June 30, 2023 at 8:01 pm বইয়ের খবর

সময় বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে দুনিয়াদারির হালহকিকত। আর এই চলতি হাওয়ার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য সবক্ষেত্রেই ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সফট স্কিল বিষয়টা। নিছক পুথি-পড়া বিদ্যা আস্তে আস্তে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে বসেছে, শাসনকাঠামোয় রাজ্যপালের ভূমিকার মতোই। আজকাল আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ম্যানেজমেন্ট ও কমিউনিকেশন স্কিল। ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, স্টোরিটেলিং -এর মতো শব্দগুলো এক দশক আগেও বিশেষ পরিচিত ছিল না, কিন্তু এখন দ্রুতই ছেয়ে ফেলছে আমাদের যাপন। ইউটিউবের নিখরচায় বিভিন্ন ফ্রি কোর্সের পাশাপাশি লোকে আজকাল ইউডেমি, কোর্সেরার মতো সাইটে লিডারশিপ স্কিল শেখার জন্য টাকা খরচ করে অনলাইন কোর্স করছে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এই একটি মানুষের জীবনকথা খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করলে বোধহয় এসব কিছুই লাগে না। ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'আলোর মানুষ' পড়তে বসে এই কথাটাই মনে হল।

এমন বিরাট মাপের একজন মানুষের জীবনকাহিনির গায়ে প্রচুর অনাবশ্যক ভক্তিরস জমে আঠা হয়ে থাকে। থাকে বিপুল পরিমাণ মিথ আর অলৌকিক গালগল্পের মেদ। তা থেকে কাহিনি ছেঁকে নেওয়া সহজ নয়। এক্ষেত্রে দুটো জিনিস লাগেই। প্রথমত বিপুল পড়াশোনা, আর দ্বিতীয়ত নির্বাচনক্ষমতা। কারণ এ-যুগে তো কেউ আর মধ্যযুগের ভক্ত-বৈষ্ণবের মতো 'Hagiography' লিখতে বসবেন না। এমন একজন ধর্মীয়-সামাজিক (রাজনৈতিকও, বলাই বাহুল্য) কিংবদন্তীকে আধুনিক সময়ের উপযোগী করে উপস্থাপনা করা সহজ কথা নয়। বিতর্ককে এড়িয়ে যাওয়া একরকম অসম্ভবই বলা চলে। ঐতিহাসিক কোনও চরিত্রকে নিয়ে লিখতে গেলে মুশকিল হচ্ছে যে, কোথাও কোথাও ইতিহাস নীরব থাকে, কোথাও আবার দশ-বিশ রকমের অনুমিতির ছড়াছড়ি। সেক্ষেত্রে লেখকের সামনে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়  'Theory of Possibility' মেনে এক নিটোল সাহিত্যিক সত্যের নির্মাণ। 

'Theory of Possibility' বা সম্ভাব্যতার সূত্র জিনিসটা ব্রহ্মাস্ত্রের চেয়ে কম কিছু না। ঠিকমতো ব্যবহার করতে জানলে কেল্লাফতে, কিন্তু অনধিকারীর হাতে পড়লে দায়িত্ব নিয়ে সর্বনাশ ঘটায়। তথ্য থেকে সত্যে যাওয়ার রাস্তা এমনিই বেমক্কা খানাখন্দ আর বাম্পারে ভর্তি। তার ওপর বিষয় যদি হন শ্রীচৈতন্য, তাহলে তো কথাই নেই। চৈতন্যের জীবনীকে চালচিত্রে রেখে গত কয়েক দশকে বেশ কিছু উপন্যাস লেখা হয়েছে। তাদের প্রায় কোনটিই কিন্তু সরাসরি শ্রীচৈতন্যের জীবনী নয়। বেশিরভাগেরই ফোকাস চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্যে। শ্রীচৈতন্যের শেষ দশ বছর বাস্তবিকই একটা পলিটিকাল থ্রিলারের চেয়ে কম কিছু নয়। ত্রিদিববাবুকে ধন্যবাদ, তিনি এই কাহিনিকে থ্রিলারের দিকে নিয়ে যাননি। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি থ্রিলার ফিকশন আমরা এ-নিয়ে পেয়ে গেছি। চৈতন্যের জীবনকথা থেকে শুধু তো 'থ্রিল' নয়, আরও অনেক মহৎ কিছু পাবার এবং শেখার আছে আমাদের। তাই তাঁকে নিয়ে এমনই একটি সৎ, অনুভবী লেখার বড় প্রয়োজন ছিল। তত্ত্ব-তথ্যের কচকচিতে ত্রিদিববাবু ভারাক্রান্ত করতে চাননি কাহিনিকে। একেবারে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে নির্ভার, লোকায়ত, সহজিয়া এক জীবনকথা শোনাতে চেয়েছেন। তবে এমন এক মহাজীবনের কথা আরও বিস্তারিত আকারে না পেলে মন ভরে না। লেখক যখন একেকটা অধ্যায় থেকে পরবর্তী অধ্যায়ে গেছেন, কখনও কখনও পেরিয়ে যেতে হয়েছে অনেকটা কালপর্ব। পাঠক হিসেবে মাঝেসাঝে সেটা অতৃপ্তির কারণ হয়েছে। 

গৌরাঙ্গের গয়াগমন অবধি অংশে লেখক মুখ্যত বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্যভাগবত' অনুসরণ করেছেন। বলা ভালো, করতেই হয়েছে, কারণ বৃন্দাবন দাসই বাংলা ভাষায় প্রথম চৈতন্যজীবনীকার। পরবর্তী সমস্ত চৈতন্যজীবনীকার গৌরাঙ্গের প্রথম জীবনের নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য তাঁকেই অনুসরণ করেছেন। এই উপন্যাসের নিমাই স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তির অধীন এক রক্তমাংসের মানুষ। চৈতন্য হবার পথে তিনি এক-এক করে বর্জন করেছেন রিপুর বাঁধন। 'আলোর মানুষ' হয়ে ওঠার সেই যাত্রাপথ মুগ্ধ হবার মতো। কাকে বলব অবতার? 'Ecce Homo' ভাবনা অনুসরণ করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর 'কৃষ্ণচরিত্র' বইয়ে বলেছিলেন - ঈশ্বর সংসারে নেমে এসে নরদেহ ধারণ করে অবতার রূপ নেন না, বরং মানুষই নিজের সমস্ত বৃত্তির সম্যক অনুশীলন, তাদের মধ্যে সফল সমন্বয়সাধন  করে  তার ফল মানবপ্রীতিতে উৎসর্গ করে অবতারত্ব প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ সোজা কথায়, অবতার মানে ঈশ্বরের অবরোহণ নয়, মানুষেরই আরোহণ। তাই অলৌকিককে ত্রিদিববাবু বাদ না-দিলেও, পাঠককে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে দেন না যে শ্রীচৈতন্য আসলে একজন মানুষ। লৌকিক-অলৌকিকের দুই সূক্ষ্ম দড়ির ওপর দিয়ে সাবধানে ভারসাম্য রক্ষা করে হাঁটতে হয়েছে ত্রিদিববাবুকে। তাতে তিনি পুরোপুরি সফল। 

নিমাইয়ের ছোটবেলার বিভিন্ন চপলতার বর্ণনা খুবই উপভোগ্য। গোটা উপন্যাস জুড়ে নানা বিষয়ে তাঁর বিচিত্ততা ও মানসিক টানাপোড়েন ভারী চমৎকার ফুটেছে। লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে নিমাইয়ের প্রেম-প্রণয়সম্পর্কের বৃত্তটি শুরু থেকে শেষ অবধি লেখক আগাগোড়া যত্নবান থেকেছেন। বর্ণনা করেছেন তাঁদের রতিক্রীড়া। পরে দ্বিতীয় স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে গৌরাঙ্গের মানসিক নৈকট্য স্থাপিত হয়নি। তাই নিয়ে নিজের কাছেই শেষমেশ অপরাধী রয়ে গেলেন গৌরাঙ্গ। অপরাধী রয়ে গেলেন নিজের মায়ের কাছেও। সব মহাজীবনের উল্টো পিঠে কিছু-না-কিছু মহৎ ত্যাগের ইতিহাস তো থাকেই। এছাড়া আরও কয়েকটা প্রসঙ্গের উল্লেখ আলাদা করে করতেই হয়। নিজের শিক্ষাগুরু হওয়া সত্ত্বেও জাতপাত নিয়ে অন্যায় করায় গঙ্গাদাস পণ্ডিতকে সংগঠিত নিম্নবর্গ জনমতের কাছে যেভাবে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করান গৌরাঙ্গ, তা অসাধারণ। খুব ভালো ফুটেছে কাজীদলন প্রসঙ্গটিও। তথ্য নিয়ে বিতর্ক থাকবেই, তবু অসামান্যভাবে বর্ণিত হয়েছে কোরান শরীফের সুরা বলে দুর্ধর্ষ দুই 'যবন' ডাকাত পন্থভীল আর নারোজীকে বশে আনার কাহিনি। ঐতিহাসিক কাহিনিতে যাতে কালানৌচিত্য দোষ এসে না পড়ে, সেজন্য বিভিন্ন ডিটেলিং-এর দিকে সতর্ক নজর রেখেছেন লেখক। কাহিনিতে প্রায়শই জলপথে দীর্ঘ যাত্রার প্রসঙ্গ এসেছে। নৌকার বিভিন্ন প্রকারভেদ নিয়ে লেখকের সচেতনতা নজর কাড়ে। থেকেছেন। মানবতাকে যিনি পথ দেখান তাঁর জীবনটা যে আসলে একটা রোড-মুভির মতোই, সে বার্তাই এ-উপন্যাসকে আলগোছে ধরে রেখেছে। 

অল্প পরিসরে প্রধান চৈতন্য-পরিকরদের প্রায় সকলকেই লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্বভাবতই অদ্বৈত আচার্য আর নিত্যানন্দ অন্যদের তুলনায় অনেকটা বেশি জায়গা পেয়েছেন। উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের আদর্শগত বিরোধের কথাও। দুজনের এই  ঠাণ্ডা লড়াই পরবর্তী সময়ে শান্তিপুর আর খড়দহ-সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীকোন্দলকে কোন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, তার মৃদু আভাস পাঠক এখানে পাবেন। অবধূত নিত্যানন্দের প্রতি লেখক একটু বেশিই কঠোর হয়েছেন কিনা এ-নিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। চৈতন্যভাগবত-রচয়িতা বৃন্দাবন দাসের পিতৃপরিচয় নিয়ে ঢাকঢাক-গুড়গুড় আছে। শ্রীবাসের ভাইঝি নারায়ণী চোদ্দ বছর বয়সে গর্ভ ধরেছিলেন। এখানে লেখকের দ্ব্যর্থহীন তির নিত্যানন্দের দিকে। তাছাড়া এ-উপন্যাসে নিত্যানন্দের আচরণ, সংলাপের ধরনধারন হয়তো পাঠকমনে সংশয়ের জন্ম দেবে। কিন্তু আগেই বলেছি, ইতিহাস যেখানে নিজেই সংশয়াকুল, সেখানে লেখক সম্ভাব্যতার সূত্র ব্যবহার করে কাহিনিকে আকার দেন। চৈতন্য নিজেও জানতেন তাঁর আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল। এ-তাঁর মানুষী দুর্বলতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। 'ইনফ্লুয়েন্সার' হিসেবে নিত্যানন্দের বিপুল জনপ্রিয়তাকে অস্বীকার করতে পারেননি তিনি। বড় বড় বিপ্লবের কো ল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে এইসব 'টুকটাক বিচ্যুতি' মেনে নিতেই হয়, এ-বোধহয় জননেতাদের ম্যানুয়ালে বরাবরের অলিখিত নিয়ম। সেদিক থেকে খুবই বাস্তবসম্মত লাগে চৈতন্যের এই 'মেনে নেওয়া'। তবে ওড়িশারাজ প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে কথোপকথনে চৈতন্যের যে-তীক্ষ্ণ কূটনীতিবোধ ঝলসে ওঠে, তার আরও একটু স্বাদ পাওয়া গেলে মন্দ হত না।    

উপন্যাসের শেষটা নিয়ে পাঠকের আলাদা আগ্রহ না থাকাটাই অস্বাভাবিক। কারণ এ-নিয়ে আজ আর কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান একটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ঘটনা। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি-র একটি উক্তি এখানে মনে পড়ছে - "চৈতন্যদেবের প্রধান পরিচয় - তিনি একটি বিশেষ ধর্মের প্রবক্তা এবং সেই ধর্মের সাহসের পরিচয় যেখানে দিতে হয়েছিল সেখানে তিনি একা।" ইতিহাস খুব স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় যে, একসঙ্গে একাধিক স্বার্থান্বেষী শক্তির ল্যাজে পা দিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তে গোবিন্দ বিদ্যাধর ভইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা এবং আরও দু-এক পক্ষ। ওড়িশার সে-সময়ের রাজনীতির ঘূর্ণিস্রোত আর ক্ষমতাকাঠামোর চেহারাটা আরেকটু বেশি দেখানো যেতে পারত বলে মনে হয়। পঞ্চসখার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেলে ভালো লাগত। বিশেষত, এই গোষ্ঠীর প্রধান জগন্নাথদাসের ভূমিকা সন্দেহজনক ছিল। সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না শ্রীচৈতন্যের দুই ছায়াসঙ্গী, ব্যক্তিগত ভৃত্য গোবিন্দ ও দেহরক্ষী কাশীশ্বর। চৈতন্যের নির্জনে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের দৃশ্য আরেকটু নাটকীয় হতে পারত।  

আসলে প্রশ্নের তো শেষ নেই। জীবনীকারদের মধ্যে যাঁরা মহাপ্রভুর শেষ দিন বিষয়ে স্পষ্ট মন্তব্য করেছেন, তাঁদের কারও সঙ্গে কারও বয়ান মেলে না কেন? চৈতন্য-অন্তর্ধানের সওয়া এক বছরের মধ্যে লিখিত 'শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়' নাটকে কেন চুপ থাকেন কবিকর্ণপূর পরমানন্দ সেন? কিংবা এরও ন-বছর পরে 'গৌড়গণোদ্দেশদীপিকা' লেখার সময়েও কেন  মৃত্যু বিষয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করেন না? মুরারী গুপ্তের কড়চার মূল পুথির কোনও খোঁজ মেলে না কেন? কেন বৃন্দাবনে নিখোঁজ হয় স্বরূপ দামোদরের কড়চা? বৃন্দাবন দাস কেন আকস্মিকভাবে শেষ করেন তাঁর কাব্য? সব বিস্তারিত বলার অঙ্গীকার করেও কেন দায়সারা গোছের মন্তব্য করে ক্ষান্ত দেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ? বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীর পর্বতপ্রমাণ লেখায় কেন পাওয়া যায় না মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বিষয়ে কোনও তথ্য? কোন-সে বাধ্যবাধকতা, যা একইসঙ্গে নবদ্বীপ আর বৃন্দাবন-গোষ্ঠীকে চুপ করিয়ে রাখে? ফাঁদে-পড়া শিকারের মতো চৈতন্যদেবকেও কি সেই একই বাধ্যবাধকতা অজ্ঞাতবাসে থেকে যেতে বাধ্য করে? যাতে চৈতন্য-অবতারের মহিমা ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্যই কি তিনি মন্দের ভালো বিকল্পটি বেছে নিয়েছিলেন? 'সচল জগন্নাথ' হিসেবে যিনি স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে নিতান্ত সাধারণ মানুষের মতো মরতে দেখলে মানুষ তাঁর ধর্মের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাত বলেই কি একরকম 'অধীনতামূলক মিত্রতা'-য় সায় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি? নাকি শুধু তাঁর একার নয়, জীবনসংশয় ছিল তাঁর পরিকরদেরও? এই সব কিছু মিলিয়েই, দাবাখেলার পরিভাষায় যাকে 'স্টেলমেট পরিস্থিতি' বলে, সেরকমই কিছু তৈরি হয়েছিল কি? ত্রিদিববাবুর ইঙ্গিত সেদিকেই। চৈতন্যের শেষ পরিণতি নিয়ে নানাবিধ অনুমিতি তৈরি হয়েছে। এ-প্রসঙ্গে গুপ্তহত্যার তত্ত্বটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে একেবারে সাম্প্রতিক ইতিহাসবিদরা কেউই সেদিকে ইঙ্গিত করছেন না। আমার ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে তুহিন মুখোপাধ্যায়ের অনুমিতি (চৈতন্যের শেষ প্রহর, পত্রলেখা)। সারঙ্গগড় (চূড়ঙ্গগড়) দুর্গে তাঁকে আমৃত্যু বন্দি করে রাখার তত্ত্বটি। ত্রিদিববাবু এ-উপন্যাসে মুখ্যত অনুসরণ করেছেন রজত পালের অনুমিতি (চৈতন্য : শেষ কোথায়, বইচই পাবলিকেশন), অর্থাৎ ছদ্মবেশে পুরী ত্যাগ। তবে স্বকল্পিত কিছু দৃষ্টিকোণও তিনি এখানে যোগ করেছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বললে স্পয়েলার হয়ে যাবে। মোদ্দা কথা হল, 'আলোর মানুষ'-এর কথকতার শেষে ত্রিদিববাবু কিন্তু আলো জ্বেলে রেখেছেন। বড় সুন্দর, মায়াময় উপন্যাসের এই শেষ জায়গাটি। মানুষটির শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তা আর কোনওদিনই নিশ্চিত করে জানা যাবে না হয়তো। তিন-চারটি কায়েমী শক্তির অশুভ আঁতাত সে-সত্যকে মাটি চাপা দিতে সক্ষম হয়েছে। এমনই গুহ্য সেই চক্রান্ত যে, সত্যানুসন্ধান করতে গিয়ে নয়ের দশকে এসেও রহস্যমৃত্যু ঘটে 'কাঁহা গেলে তোমা পাই'-এর রচয়িতা ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের। যাই হোক, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা উপন্যাসের কাজ নয়। ইতিহাসের দায়িত্ব ইতিহাসকে পালন করতে দেওয়াই ভালো। সাহিত্য-শিল্পের কাজ যে-সত্যকে নিয়ে, তা ইতিহাসের প্রদেয় তথ্যের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইতিহাস আর ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাসের তফাৎ তো এখানেই। প্রথমটির কাজ 'ফ্যাক্ট' নিয়ে, দ্বিতীয়টির অন্বিষ্ট 'ট্রুথ'। নিমাই থেকে শ্রীচৈতন্য হয়ে ওঠা আসলে এক আলোকময় মহাযাত্রা শুধু না, এক দুঃসাধ্য সাধনার ইতিবৃত্তও বটে। পাঠককে 'ফ্যাক্ট' থেকে 'ট্রুথ'-এ নিয়ে যেতে পারাটা ঐতিহাসিক কাহিনিকারের পক্ষে ততটাই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। 'আলোর মানুষ' সেই সত্যকে ছুঁতে পেরেছে। আসল আলো তো সেখানেই।      

.................. 

#আলোর মানুষ #ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় #পত্রভারতী #শ্রীচৈতন্য #বই রিভিউ #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

58

Unique Visitors

182979