বিবিধ

পিৎজা-কাহিনি

পথিক মিত্র Aug 26, 2023 at 8:43 pm বিবিধ

" I love it, you love it, Even the Ninja Turtles love it..."

এই বাক্যটি আমেরিকায় এক সময় দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সেই জনপ্রিয়তা শিশু কিশোরদের মধ্যে দেখা গেলেও, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই বস্তুটি সমগ্র মার্কিন মুলুকে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সফল হয়। 

একটি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং বলেছিলেন যে, তার খাওয়া সেরা পিৎজা নাকি সোনিয়া গান্ধী বানিয়েছিলেন। তিনি সেই পিৎজার সিক্রেট রেসিপি জানানোর অনুরোধ অবধি করেছিলেন শ্রীমতী গান্ধীকে। বিষয়টা নিছক ঠাট্টা হোক বা অর্ধসত্য, আজকের সময় দাঁড়িয়ে এটা মানতে কারোর কোনো সমস্যা নেই যে, এই পিৎজা নামক খাদ্যবস্তুটি দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে একটি আন্তর্জাতিক খাদ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। যদিও আমেরিকানরা গলার জোরে বারবার প্রমাণ করতে চায় যে আজকের এই পিৎজা একান্ত তাদের সৃষ্টি, কিন্তু আদতে পিৎজার জন্ম আদতে আমেরিকার জন্মের বহু আগে। 

অবশ্য বর্তমানে আমেরিকানদের পিৎজা-প্রীতিকে সমীহের চোখে না দেখে উপায় নেই। ভাবতে পারেন, National Association of Pizza Operators-এর করা একটি সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে যে আমেরিকানরা প্রতি দিনে ১০০ একর পিৎজা খেয়ে থাকেন? অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে আমেরিকায় গড়ে ৩৫০ টি পিৎজা স্লাইস খাওয়া হয়ে থাকে! মিন্টেল সংস্থার করা আর একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে ৯৩ শতাংশ আমেরিকান মাসে কমপক্ষে একবার পিৎজা খেয়ে থাকেন। সে কথা থাক, আপাতত আমরা ইতিহাসের পাতা উল্টে খুঁজব পিজার জন্মবৃত্তান্ত।  

প্রথমেই চলুন যাওয়া যাক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সারডিনিয়া। কারণ সেখানেই  প্রথম ইস্ট ব্যাবহার করে ব্রেড বা পাউরুটি বানানোর প্রণালী আবিষ্কৃত হয়। এরপর ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তৎকালীন গ্রীক সাম্রাজ্যে প্লাকাউস বা প্লাকুটাস নামক একটি ফ্ল্যাট ব্রেডের চল দেখা যায়। এই ব্রেডের সঙ্গে স্বাদবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হত রসুন ও বিভিন্ন মশলা। যেহেতু এই প্রথম পাউরুটি বা ব্রেডের উপর স্বাদের জন্য অন্য জিনিস দেওয়া চালু হল, কাজেই প্লাকাউস-কে পিৎজার পূর্বপুরুষ বলে ধরে নিতে কোনো অসুবিধে নেই। ৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি ভারী মজার ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা পিজার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। পারস্যের রাজা দারায়ুস দ্য গ্রেট তখন গ্রিস, মেসিডোনিয়া, থ্রেস, মিশর সহ গোটা বিশ্ব জুড়ে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করছেন। তাঁকে রাজাদের রাজা বা 'king of kings' উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁর অনেক অবদানের মধ্যে পিজা-শিল্পে তার অবদান হয়তো ইতিহাস সেভাবে মনে রাখে না। কিন্তু এ-ঘটনা যেমন অভিনব তেমনই মজাদার। তিনি নাকি তাঁর সেনাদের ঢালের ওপরপ্রান্তে একটি কাঁচা পাউরুটি লাগিয়ে দিতেন যা সারাদিনে রোদে ঝলসে আপনাআপনি বেক হয়ে যেত। রাতে ঢাল থেকে খুলে সেই ব্রেড খেজুর ও জলপাই সহযোগে খাওয়া হত। বুঝতেই পারছেন, পিৎজার সঙ্গে অলিভ বা জলপাইয়ের বন্ধুত্বটা আজকের নয়।

৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক দার্শনিক কেটো দি এল্ডার লিখছেন, তৎকালীন সময় বড় বড় পাথরের উপর চ্যাপটা পাউরুটি বা ফ্ল্যাট ব্রেড বেক করা হত জলপাইয়ের তেল সহযোগে। তার জনপ্রিয়তা বেশ থাকলেও, প্রাথমিকভাবে এটা গরীব লোকের খাদ্য ছিল। কেটো যদি বর্তমানে কোনো পিজেরিয়া বা পিজার দোকানে যেতেন তার নিশ্চিত বুকে কিঞ্চিৎ ব্যথা হত! বা বলতে পারেন চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেত। ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশেপাশে লাতিন কবি ভার্জিল তাঁর 'ইনিড'গ্রন্থে লিখছেন এক মজার কথা। তৎকালীন সময় একটি শক্ত চ্যাটালো ব্রেডকে কড়া করে বেক করে, চপিং বোর্ড বা সবজি কাটার তক্তা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পেঁয়াজ, রসুন, টমেটো ইত্যাদি কাটা হতো সেই ব্রেডের উপর রেখে। স্বাভাবিক নিয়মেই পেঁয়াজ, টমেটোর কিছু অবশিষ্ট টুকরো পড়ে থাকত সেই রুটির উপর। জলের সংস্পর্শে এসে ব্রেডটাও কিছুটা নরম হত। তারপর সেটাই হত, যেটা যুগ যুগ ধরে বাড়ির মহিলারা করে আসছেন। বাড়ির সবার খাওয়া সম্পন্ন হওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির মহিলারা সেই ব্রেড খেয়ে নিতেন। ধরে নেওয়া যেতে পারে, পিৎজার ইতিহাসে এটাই প্রথম টপিং।

এবার চলে আসছি, ৭৯ খ্রিস্টাব্দে। মাউন্ট ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা ধংস করে দেয় পম্পি নামক বন্দর-নগরীটিকে। কী মর্মান্তিক সেই ধ্বংসলীলা তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় লাভার আচ্ছাদন সরিয়ে পম্পি শহরটির ফের আবিষ্কার হওয়ার পর। কি ভীষণ উন্নত ছিল তাদের শিল্প, রাস্তাঘাট, সংস্কৃতি - তার বহু নিদর্শন পাওয়া যায় পম্পের ধ্বংসাবশেষে। মজার কথা হল, ৭০ খ্রিস্টাব্দের পম্পি শহরে যে পাথরের ওভেন পাওয়া গেছে তা অবিকল আমাদের বর্তমান পিৎজা ওভেনের মত! ফ্ল্যাট ব্রেডের চল যে পম্পি নগরী তে ছিল তার প্রভূত প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইউরোপে ফ্ল্যাট ব্রেডের বেশ রমরমা দেখা যায়। ক্যাটালানরা বলছে কোকা, এট্রাস্ক্যানরা বলছে ফ্ল্যাট ব্রেড আর সারডিনিয়ানরা বলছে ক্যারাসু। এক জিনিস কিন্তু বহু নাম। তাহলে হঠাৎ এই পিৎজা নামকরণ হল কোথা থেকে? সেটা জানার আগের এটা বলে নেওয়া ভালো যে, হেলানো টাওয়ার-খ্যাত পিসা শহরের সাথে কিন্তু পিজার কোনও সম্পর্ক নেই। অনেকেই গুজব হিসেবে শুনে থাকতে পারেন যে পিৎজার জন্ম হয়ত পিসা নগরীতে, কিন্তু ব্যাপারটা নিছকই গুজব। ইটালীয় ভাষায় পিসা এবং পিৎজা দুটি শব্দের উচ্চারণ একদম ভিন্ন। তাহলে কী করে হল এই নামকরণ? 

বিষয়টা নিয়ে মূলত তিনটি তত্ত্ব আছে। লাতিন ভাষায় 'পিনসা' বা 'পিনসারে' একটি ক্রিয়া, যার অর্থ চ্যাপটা করা। পিৎজার উৎসমূলে এই শব্দটি থাকতে পারে। আবার গ্রিক ভাষায় 'পিকটা' বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ " Fermented pastry"! এই শব্দ থেকেও 'পিৎজা' নামটি এসে থাকতে পারে। অবশ্য আর একটি গ্রীক শব্দ 'পিটা', পিজার শব্দের পিতা হওয়ার জোরালো দাবিদার। এই শব্দের অর্থ গমের ব্রেড। পিটা ব্রেড বর্তমানে লেবানিজ খাবারের মধ্যমণিও বটে।

যাই হোক নির্দিষ্ট ভাবে পিৎজা শব্দের নামকরণ-রহস্য সমাধান না করা গেলেও পটজা শব্দের প্রথম লিখিত রেকর্ড পাওয়া যায় দক্ষিণ ইতালির গেতা বা গায়তা শহরে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে। একটি নথি বলছে, একজন লোক নিজেকে পাপমুক্ত করতে খ্রিস্টমাস বা ইস্টার উপলক্ষ্যে গেতার বিশপকে ১২ টি পিজা ভেট বা উপহার দেবেন। ১২ টা পিৎজা বা 'Duadachim pizzae' শব্দবন্ধই হল পিৎজার প্রথম লিখিত নথিভুক্তকরণ। এটা মনে রাখতে হবে যে প্রায় সপ্তদশ শতাব্দী অবধি পিৎজা কিন্তু শুধুমাত্র একটি সাদামাটা খাবার ছিল। গরীব, মধ্যবিত্তের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা থাকলেও উচ্চবিত্তের মধ্যে তখনও পিৎজা ব্রাত্য। তখনও কিন্তু পিৎজা শুধু মাত্র একটি ফ্ল্যাট ব্রেড যার উপরে সালসা বিয়ানকা বা হোয়াইট সসের প্রলেপ লাগানো।  

১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই পিৎজার একটি নতুন যাত্রাপথ শুরু হল, যা অনুসরণে করে বর্তমানে পিৎজা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চর্চিত খাদ্যবস্তুদের তালিকার শীর্ষে। এই সময় থেকে নেপলস-এর বার্বন শাসকদের মধ্যে পিৎজা খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ফরাসি শাসকদের অধীনে দুগ্ধ শিল্প প্রভূত উন্নতি করতে থাকে ক্রমাগত। মোষের দুধ থেকে উৎকৃষ্ট মোজারেলা চিজ উৎপাদন করা শুরু হয় বার্বন রাজাদের আমলে। এই উৎকৃষ্ট সুস্বাদু চিজ তাঁরা ব্যবহার করেন তাদের পিৎজাতে। ব্যাস! কেল্লা ফতে! পিৎজার ইতিহাসে এই সেই বৈপ্লবিক মুহূর্ত! পিৎজা এবং চিজের যে বৈবাহিক সম্পর্ক সেই শুরু হল তা আজও লক্ষ লক্ষ লোককে আনন্দ দিয়ে চলছে। কাজেই বলাই যেতে পারে যে আধুনিক পিৎজার জন্ম আদতে সেই নেপলসেই। যদিও টমেটোর ব্যবহারটা পেরু ঘুরে ইতালিতে এসেছে। কেউ কেউ বলেন টমেটো স্পেনের কোনো নাবিকের হাত ধরে ইতালি এসেছিল। 

টমেটো এবং নাবিকদের কথাই যখন উঠল তাহলে বলা যাক পিৎজা মারিনারার ( pizza marinara) গল্প। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নাবিকদের মধ্যে অতীব জনপ্রিয় ছিল এই পিৎজাটি। এটিকে তাই "sailor s pizza" বলেও সম্বোধন করা হত। টমেটো আর অঞ্চোভি মাছের শুঁটকিকে টপিং হিসেবে ব্যবহার করা হতো এই পিৎজাতে। টমেটো সস এবং সালসা সসের ব্যবহারও সেই সময় লক্ষণীয় ছিল। অন্য পিৎজার তুলনায় অনেক বেশি ঝাল হত এই পিৎজাটি। সমগ্র নাবিকসমাজে এই পিৎজার চাহিদা ছিল তুঙ্গে। তবে এটা মানতে হবে, নাবিক মহলে এই পিৎজার দারুণ বাজার হওয়া সত্তেও তথাকথিত উচ্চবর্গের নজরে কিন্তু এই পিৎজা গরীবের খাবার বলেই পরিচিত ছিল। তাহলে জনপথে থেকে সোজা রাজমহলের অন্দরে কে ঢোকাল পিৎজাকে?

নামটা মনে রাখবেন। পিৎজার ইতিহাসে এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নাম। রাফায়েল এস্পোসিতো নামের এক বেকার। না ভদ্রলোক বেকার ছিলেন না মোটেই। উনি বেক (bake) করতেন। এই রাফায়েলের হাতেই জন্ম নেয় পিৎজা মার্গারিটা। সাবোই-এর মহারানি মার্গারিটার জন্য ইতালির পতাকার রঙের আদলে তিনি তৈরি করেন তার কালজয়ী পিৎজাটি। লাল, সাদা আর সবুজ - এই তিন রঙের মিশ্রণে তৈরি হল এই বিশেষ পিৎজা। লাল হল টমেটো পিউরি, সাদা হলো বিখ্যাত বাফেলো মজেরেলা চিজ আর সবুজ হলো বেসিল। খেয়ে রানি দারুণ খুশি হলেন। বিস্তর পুরস্কার পেলেন রাফায়েল, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই পিৎজা ঢুকে গেল রাজপরিবারের ডাইনিং রুমে।

পিৎজা নিয়ে এত কথা বলছি যখন এটা পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো যে সেই যুগে কিন্তু পিৎজা প্রধানত থিন ক্রাস্ট হতো। আকারেও ইতালির পিৎজা কিন্তু আমেরিকান পিৎজার তুলনায় অনেক ছোট। আসলে ইতালিতে স্লাইস করে পিৎজা ভাগ করে খাওয়ার প্রচলন ছিল না। এটা পুরোটাই আমেরিকার আমদানি। অষ্টাদশ শেষের দিকে বিভিন্ন কারণে প্রচুর ইতালীয় নাগরিক পাড়ি দেন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, মূলত আমেরিকায়। ধরে নেওয়া যেতে পারে তাদের হাত ধরেই পিৎজা পৌঁছে যায় মার্কিন মুলুকে। ১৯০৫ সাল নাগাদ গেনারো লম্বার্দি নামক এক ইতালীয় অভিবাসী নিউ ইয়র্ক সিটিতে প্রথম পিৎজা জয়েন্ট বা পিজেরিয়া খোলেন। বছরখানেকের মধ্যেই নিউ জার্সিতে ফ্রাঙ্কো পেপে তার কয়লার ওভেনযুক্ত পিজেরিয়া খোলেন। এভাবেই পিৎজার ঘাঁটি ক্রমাগত শক্ত হতে থাকে মার্কিন মুলুকে। চিজ ব্যবহারে পিৎজাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে থাকেন আমেরিকানরা। আমদানি হতে থাকে নতুন নতুন টপিং-এর। টপিং-এর ক্ষেত্রে ইতালিয়ান সেফরা বেশ কিছুটা রক্ষণশীল ছিলেন। কিন্তু আমেরিকায় হ্যাম, অলিভ, আর্টিচোক, ভুট্টা, মাশরুম থেকে আরম্ভ করে চিংড়ি, কাকড়া, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ টপিং হিসেবে ব্যাবহার হতে লাগলো চার আলাদা রকমের চিজ মিশিয়ে তৈরি হলো পিৎজা 'এই কত্র'। মজারেলা, গর্গনজেলা, তালাজিও, গ্রুয়ারে - চার প্রকারের উৎকৃষ্ট চিজ-সমৃদ্ধ এই পিজা অল্প সময়েই ভোজনরসিকদের মন জিতে নিতে সক্ষম হল। স্বাদে, গুণে, চিজ আর টপিং-এর প্রাচুর্যে ১৯৪০-এর পর থেকে আমেরিকান পিৎজা কড়া মোকাবিলা করতে লাগল সাবেকি ইটালিয়ান পিৎজার। তখন ইউরোপ জুড়ে বাজছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধকালীন সময় চটজলদি তৈরি স্থানীয় খাবারের চাহিদা বাড়ে। যুদ্ধের সময় যে আমেরিকান সৈন্যরা ইতালিতে যায় লড়াই করতে, তারা যখন দেশে ফেরে, তাদের সাথে মার্কিন মুলুকে আরো বেড়ে যায় পিৎজার চাহিদা। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমগ্র বিশ্বে পিৎজা নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে।

পিৎজার ব্যবসায় দুই বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বী পিৎজা হাট ও ডমিনোস মার্কিন মুলুকেতাদের প্রথম পিজারিয়া খোলেন যথাক্রমে  ১৯৫৭ ও ১৯৬০ সালে। এই মুহূর্তে ব্যবসার নিরিখে ডমিনোস তার প্রতিদ্বন্দ্বী পিজা হাটকে কিছুটা পিছনে ফেলে দিলেও এই দুটি চেনেরই নিজস্ব ভক্তকুল আছে।

যাই হোক, আমেরিকায় আসার পর থেকেই রূপে-গুণে পিৎজার প্রভূত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন ধরুন প্রাথমিকভাবে ইতালিয়ান পিৎজা ছিল চৌকো,আমেরিকান পিৎজা মূলত গোল। ১৯৩৩ সালে নিউ ইয়র্কের পাস্টি পিজেরিয়াতে প্রথম বার পিৎজা স্লাইস রূপে বিক্রি হতে থাকে, যেটা আগে ইতালিতে কখনোই হত না। পাস্টির দেখাদেখি সবাই এক জিনিস চালু করে দিল। মার্কিন প্রভাবে পিৎজার রাতারাতি এইরকম সব বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখে কিন্তু খোদ ইতালিয়ানরা কিছুটা ঈর্ষা কাতর হয়ে পড়ে। জন্ম হয় নাপোলির ওয়ার্ল্ড পিৎজা অ্যাসোসিয়েশন এর। তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী বর্তমানে পিৎজা তৈরি হয় বিশ্ব জুড়ে আর তাদের নিয়মগুলি না মানলে আইনত আপনি 'পিৎজা' নামটি ব্যাবহার করতে পারবেন না। এমনকি ইতালির পার্লামেন্টে 'ট্র্যাডিশনাল ইতালিয়ান পিৎজা' সংরক্ষণ করার জন্য একটি বিশেষ বিলও পাশ করানো হয়। 

পিৎজাকে ঘিরে বিশ্ব জুড়ে উন্মাদনার শেষ নেই। বাচ্চা, বুড়ো সবার পছন্দের খাবারের তালিকায় এখন পিৎজা থাকছে। তবে পিৎজা নিয়ে অদ্ভুত গল্পের শেষ নেই। আচ্ছা বলুন তো সব থেকে দূরে কোন পিৎজা ডেলিভারি হয়েছে আর কোথায়? 

২০০১ সালে রাশিয়ান স্পেস এজেন্সি প্রায় এক মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটি ৬ ইঞ্চির পিৎজা ডেলিভারি করায় ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে, তাদের মহাকাশচারি ইউরি উসাচব-এর জন্য। সম্ভবত উনিই একমাত্র মানুষ যিনি মহাকাশে পিৎজা ডেলিভারি নিয়েছেন। পিৎজা নিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বেশ কয়েকটি রেকর্ড নথিভুক্ত আছে। যেমন, বিশ্বের সব থেকে দামি পিৎজা প্রায় বারো হাজার ডলার এর, তৈরি হয়েছে ইতালির Salerno শহরে। আবার ইতালির সেফ ডিভিলিও নারদি এবং তার দল রোমে নির্মাণ করেন বিশ্বের বৃহত্তর পিজা, যার পিৎজার আয়তন ছিল সাড়ে তেরো হাজার বর্গ ফিট। পিৎজা না একটা আস্ত খেলার মাঠ - বোঝা দায়! ২০০৬ সালে রোমানিয়ার খ্রিস্টান দিমিত্রি এক সপ্তাহে ২০০ পাউন্ড পিৎজা খেয়ে একটি ব্যাক্তিগত বিশ্বরেকর্ড তৈরি করেন। 

ধীরে ধীরে ইউরোপ আমেরিকা ছেড়ে পিৎজা পাড়ি দেয় এশিয়া, আফ্রিকাতে। স্থান,কাল পরিবর্তন এর সঙ্গে সঙ্গেই পিৎজার স্বাদেরও পরিবর্তন দেখা যায়। ভারতে যেমন পনির পিজা, চিকেন টিক্কা মসলার মত বিভিন্ন নতুন ফ্লেবার যোগ হতে থাকে। জাপানে পিৎজাতে মেয়োনিজ ব্যাবহার করার চল দেখা যায়। আমেরিকা-বিরোধী উত্তর কোরিয়া বহুদিন তাদের দেশে ঢুকতে দেয়নি পিৎজাকে। কিন্তু শোনা যায় গুজবে যে উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং-২ এর নাকি বড় প্রিয় ছিল পিৎজা। তাই ২০০৯ সালে উত্তর কোরিয়াতে খোলে প্রথম পিজেরিয়া। 

অতএব, এটা মেনে নেওয়া যেতেই পারে যে পিৎজা মোটামুটি গোটা বিশ্বটাই জয় করে ফেলেছে। পুরুষ, নারী, গরীব, বড়লোক, ছোটো, বড় সবার সমস্ত রকম বিভেদ ঘুচিয়ে এক খাবার টেবিলে তাদের আহ্বান করতে সক্ষম পিৎজা। তাই পিরজাকে বিশ্বের জনপ্রিয়তম খাদ্যসামগ্রীর তকমা দিতে আমাদের খুব একটা আপত্তি থাকা উচিত নয়। 

শেষ করার আগে দুজনের কথা বলব। হলিউড অভিনেতা জন ক্লা ভান্ডেম আর কমেডি অভিনেতা বিল মুর। এঁরা দুজনেই তাদের অল্পবয়েসে পিৎজা ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করেছেন। বিল তো আজীবন পিৎজার একনিষ্ট ভক্ত ছিলেন, আর তাই তাঁর একটি উক্তি দিয়ে পিজার এই আলোচনায় ইতি টানব। 

বিল লিখছেন - "Unless you are a pizza, the answer is yes, I can live without you." 

..................... 


#Pizza #Dominoz #Pizza Hut #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

57

Unique Visitors

183065