ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

'পারফেক্ট ডেইজ' : কিছু না-থাকার সিম্ফনি

বিবস্বান দত্ত Dec 9, 2023 at 6:44 pm ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব এখন যে জন্য আলোচনার কেন্দ্রে , তা রবীন্দ্রসংগীতের বদলে-দেওয়া শব্দ অথবা উদ্বোধক সলমন খান। এই সমস্ত সারেগামা পেরিয়ে যে জন্য কলকাতা চলচিত্র উৎসব, যদি শুধু সেই দিকে নজর ফেরানো যায় তাহলে দৃশ্যের কিছু পরিবর্তন মিলতে পারে।

আমি সিনেমাবোদ্ধা নই। কাজেই আমার পাঠ এক রসগ্রাহী দর্শকের আত্মকথন মাত্র। লেন্সের ব্যাকরণ অথবা প্রাযুক্তিক খুঁটিনাটি এই লেখায় মিলবে না। 

এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা নিয়েই গতকাল প্রদর্শিত একটি জাপানি সিনেমার দিকে নজর ফেরাই। উইম ওয়ান্ডার্স-এর 'পারফেক্ট ডেইজ'। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে ২০২৩-এই। 

কী আছে এই সিনেমায়? এক কথায় কিছু না। আর সেই না-থাকাটুকু ভরে আছে অজস্র দৃশ্যে। গাছের পাতার ফাঁকে সূর্যের উঁকি দেওয়ায়। বৃষ্টিতে ঢেকে যাওয়া টোকিও শহরে। 

চলচ্চিত্র সমালোচনার প্রথাসিদ্ধ ব্যকরণ সমালোচনায় গল্প বলে দেওয়ার ঘোর বিরোধী। অথচ এই সিনেমার ক্ষেত্রে সেই ভয় নেই। কারণ এই সিনেমা গল্পপ্রধান নয়। বরং এই সিনেমার গল্প এগোয় খুব অলসভাবে। অথবা এগোয় না। 

সিনেমার মূল চরিত্র হিরায়ামা নামের একজন একা মানুষ। পেশায় সে টোকিওর টয়লেট ক্লিনার। তাঁর দৈনন্দিন যাপন উঠে এসেছে এই সিনেমায়। সেই যাপন খুব একঘেয়ে। বেরঙিন। অথচ চরিত্রটি তাতে বিরক্ত নয়। সে নিজের সেই একঘেয়ে একাকী যাপন বড়ো ভালোবাসে। প্রত্যেকদিন সূর্য ওঠার আগেই উঠে পড়ে সে। বিছানা গোছায়। দাঁত মাজে। গোঁফ সমান করে কাঁচি চালিয়ে। ট্রিমার ঘষে দাড়ি কমায়। গাছে জল স্প্রে করে। পরে নেয় প্রাত্যহিক জিপশুট। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা কফি। গাড়ি করে নিজের কাজে। এই সমস্ত দৈনন্দিন কাজ এক নিপুণ অলস অনুপুঙ্খ সূক্ষ্মতায় ধরতে থাকেন উইম ওয়ান্ডার্স। 

হিরায়ামার কাজটা খুবই একঘেয়ে। প্রাত্যহিক শহরের পাবলিক টয়লেট পরিষ্কার। আর এই কাজটা হিরায়ামা করে সম্পূর্ণ মন ঢেলে। তার অখণ্ড মনোযোগ দেখে সহকর্মী প্রশ্ন করে, সত্যিই এই কাজটা তুমি এত ভালবাস? হিরায়ামা উত্তর দেয় না। 

খুব কম কথা বলে হিরায়ামা। পুরো সিনেমায় প্রয়োজন ছাড়া সে একটাও কথা বলেনি। তার দিন শেষ হয় কোনও না কোনো বই পড়তে পড়তে। কাজে ফাঁকে পুরনো ক্যামেরায় পাতার ফাঁকে সূর্যের ছবি তোলা তার নেশা। আর নেশা হলো গাছ, জ্যাজ মিউজিক।

সমস্ত রকম বাহুল্যকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে এক আশ্চর্য শান্ত চরিত্র টোকিওর এই টয়লেট ক্লিনার। তার ছুটিগুলোও একরকম দেখতে। এই দিনে সে পাবলিক ওয়াশিং স্পেসে নিজের জামা ধুতে যায়। আর এক সুন্দর পাবে সামান্য পান ভোজন। পাবের মালিক এবং কর্মচারী এক জন একা বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা। যে মহিলার সূত্রেই একদিন, মাত্র একদিন নিটোল নিয়মে চলা হিরায়ামার দিনের রুটিন সামান্য বদলাবে। তারপর হিরায়ামা আবার ঢুকে যাবে তার প্রাত্যহিক দিনে। শুধু সূর্যোদয়ের দেশের প্রথম সূর্য যখন হিরায়ামার মুখে এসে পড়বে, তখন সেই মুখ একই সঙ্গে ভেসে যাবে হাসিতে আর কান্নায়। 

এমন নিচু তারে বাঁধা সিনেমা, নিচু তারে বাঁধা কোজি ইয়াকুসোর অভিনয়, এটাই এই সিনেমার সম্পদ। আসলে আমাদের দিনযাপন খুব বৈচিত্র্যে ভরা থাকে না। আমাদের প্রত্যেকটা দিন আস্তে আস্তে একরকম দেখতে হয়ে যায়। তবু সেই একঘেয়ে জীবনকেও ভালোবেসে ফেলি আমরা। প্রত্যেকদিন কাজে বেরিয়ে উঁকি মেরে আকাশ দেখি। রাস্তার ছন্ন পাগলের প্রলাপের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। পারফেক্ট ডেইজ সেই ভালোবাসার গল্প বলে। একাকিত্বের গল্প বলে। বেঁচে থাকার গল্প বলে। নিজের ভাগ্নি নিকোকে সমুদ্র দেখতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার। সে বলেছিল সমুদ্র দেখতে যাওয়া যাবে পরে। নিকো জিজ্ঞেস করে, পরে মানে কখন? হিরায়ামা বলে পরে মানে পরে, এখন মানে এখন। 

এই আপাত-বেরঙিন এখনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে কত অলীক খাজানা। এক পাবলিক টয়লেটে রেখে যাওয়া কাটাকুটি খেলার পাতার মতো। কোনো অচেনা মানুষের সঙ্গে যে-খেলা চলতে থাকে। আমাদের জীবন ফুরিয়ে যায়। 

কখনোও সুযোগ এলে এই সিনেমা আবার দেখা যাবে। বারবার দেখা যাবে।

.............................


#Perfect Days #Wim Wenders #Japanese Film #Film Review #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

27

Unique Visitors

213140