খেলা

একটি বিমান দুর্ঘটনা এবং মাদ্রিদ-ম্যানচেস্টার বন্ধুত্বের গল্প

অর্পণ দাস Feb 8, 2024 at 7:15 pm খেলা

স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ আর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড—ফুটবল বিশ্বের দুই মহাশক্তিধর ক্লাব। শতাব্দীপ্রাচীন দুই ক্লাবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অসংখ্য ইতিহাস আর ঐতিহ্য। ট্রফি ক্যাবিনেট গল্প বলে চলে তাদের সাফল্যের। রিয়াল মাদ্রিদের যদি থাকে ১৪ বার ইউরোপ সেরা হওয়ার তকমা, তো ম্যানচেস্টারের ক্লাবের ঘরে আছে ১৩টি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ট্রফি। আর একজনের কথা না বললে দুই ক্লাবের ইতিহাসই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ম্যানচেস্টারে তাঁর কেরিয়ারের প্রতিষ্ঠাপর্ব, মাদ্রিদে তিনি হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি।

২০০৯ সালে যখন রেকর্ড পরিমাণ অর্থে ম্যানচেস্টারের লাল জার্সি ছেড়ে রোনাল্ডো মাদ্রিদের সাদা জার্সি গায়ে তোলেন, তখন অনেক ভক্তই বদলে নেয় নিজের পছন্দের দল। রোনাল্ডোর সঙ্গেই বহু সমর্থকের হৃদয়ে বাসা বাঁধে একই সঙ্গে দুই ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা। তবে এর বাইরেও এক অদ্ভুত যোগসূত্রে বাঁধা পড়ে আছে ম্যানচেস্টার ও মাদ্রিদ। যার সূত্রপাত প্রায় ৬৬ বছর আগে। শুরুর গল্পটা বেদনাদায়ক, কিন্তু তারপর ‘বন্ধু চল, বলটা দে’-র মতো একে-অপরের হাত ধরে দুই প্রতিষ্ঠান এগিয়ে গেছে ভবিষ্যতের সাফল্যের দিকে।

১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি—শুধু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নয়, সারা বিশ্বের ফুটবলের কাছেই এক কালো দিন। ইউরোপিয়ান কাপের ম্যাচে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার ক্লাব রেডস্টার বেলগ্রেডকে হারিয়ে ঘরে ফিরছিল ইংল্যান্ডের ক্লাব। মাঝে তাদের বিমান দাঁড়িয়েছিল জার্মানির মিউনিখে। কিন্তু সেখান থেকে উড়ান নিতেই নেমে আসে এক ভয়ানক বিপর্যয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে ভেঙে পড়ে ব্রিটিশ ইউরোপিয়ান এয়ারওয়েজের ‘ফ্লাইট ৬০৯’ বিমানটি। মোট ৪৪ জন যাত্রীর মধ্যে মারা যান ২৩ জন। যেখানে ছিলেন ইউনাইটেডের ৮ জন ফুটবলার ও ৩ জন স্টাফ। গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান ম্যানেজার ম্যাট বাসবি-সহ ববি চার্লটন, হ্যারি গ্রেগের মতো ফুটবলাররা। আজও প্রয়াত ফুটবলারদের স্মৃতিতে শোকপালন করা হয় ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড স্টেডিয়ামে।

এই মর্মান্তিক ঘটনার পর ঘরে-বাইরে দুরবস্থার মুখে পড়ে ইউনাইটেড। বাসবি বেছে বেছে তৈরি করেছিলেন তরুণ ফুটবলারদের। যে কারণে তাঁদের নাম ছিল ‘বাসবি বেবস’। সারা মরশুম জুড়েই তাঁরা দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিচ্ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার পর নতুন করে দল গঠন করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। একের পর এক হারে চোখ রাঙাতে থাকে অবনমনের ভয়। তার সঙ্গে নেমে আসে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। 

আর সেই সময়েই যেন এক বহু পরিচিত বন্ধুর মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল রিয়াল মাদ্রিদ। তখন স্পেনের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সান্তিয়াগো বার্নাবেউ। যাঁর নামে আজ মাদ্রিদের স্টেডিয়াম নামাঙ্কিত। আর মাদ্রিদ মানেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ তারকাদের ছড়াছড়ি। ফেরেঙ্ক পুসকাস, ডে স্টেফানো, পাকো জেন্টোর মতো খেলোয়াড়রা তখন সাদা জার্সিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ইউরোপীয় ফুটবলে। প্রাথমিকভাবে রিয়ালের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে স্পেন ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানানো হয় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ফুটবলারদের। যদিও সে নেহাত মাঠের বাইরের কথা। কিন্তু এরপরে তারা যে পদক্ষেপ নেয়, তা বিশ্বের আর কোনো ক্লাব এতটা তাগিদ নিয়ে কখনও করেছে কিনা গবেষণার বিষয়। 

আর্থিকভাবে ধুঁকতে থাকা ম্যানচেস্টারকে বাঁচানোর জন্য রিয়ালের পক্ষ থেকে একাধিক ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’-এর প্রস্তাব দেওয়া হয়। সাধারণত সেই সময়ে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য রিয়াল ১২০০০ ইউরো নিত। কিন্তু বাসবির ফুটবল মস্তিষ্কের ভক্ত বার্নাবেউ অর্ধেক মূল্যে প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য রাজি হয়ে যান। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২-র মধ্যে মোট পাঁচটি ম্যাচ খেলা হয়। এমন নয় যে, ‘দুর্বল’ ইউনাইটেডের আর্থিক পরিস্থিতি ভালো করে তোলার জন্য রিয়াল দয়া দেখিয়েছিল। বরং খেলোয়াড়ি মনোভাব বজায় রেখে পূর্ণশক্তির দল নামিয়েছিল। শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে খেলে আখেরে যে ইউনাইটেডের লাভই হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বছর দুয়েকের মধ্যে। 

প্রথম ম্যাচটি খেলা হয় ১৯৫৯ সালের ১ অক্টোবর, ‘থিয়েটার অফ ড্রিমস’ বলে বিখ্যাত ওল্ড ট্রাফোর্ড স্টেডিয়ামে। ফলাফল রিয়ালের পক্ষে ৬-১। পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো সেটা প্রথম ও শেষবার, যখন চূড়ান্তভাবে পরাস্ত একটি টিমের সমর্থকরা হাততালিতে সম্বর্ধনা জানিয়েছিল বিজয়ী টিমকে। হ্যাঁ, ইউনাইটেডের ভক্তরা এভাবেই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল মাদ্রিদকে। এমনকি ‘গার্ড অফ অনার’ দেওয়া হয় মাদ্রিদের প্লেয়ারদের। আর এই ফলাফলই ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে বাসবির দলকে। পরের ম্যাচেও অবশ্য ইউনাইটেড হেরে যায়। কিন্তু সেবার ফলাফল ৬-৫। ববি চার্লটন, কুইক্সাল, ভায়োলেটদের সামলাতে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়েছিল রিয়ালের খেলোয়াড়রা। ফলাফল দেখে কে বলবে এই মাদ্রিদই কয়েক সপ্তাহ পরে ফ্রাঙ্কফার্টকে ৭-৩ গোলে হারিয়ে ইউরোপ সেরার খেতাব জিতবে? ১৯৬০ সালে স্কটল্যান্ডের হ্যাম্পডেন পার্কে এই ম্যাচটি দেখতে উপস্থিত ছিলেন এক ব্যক্তি। পরে তিনি বলেছিলেন, ম্যাচটি তাঁর ফুটবল সম্পর্কে চিন্তাভাবনা বদলে দিয়েছিল। সেই ব্যক্তির নাম অ্যালেক্স ফার্গুসন।

ওদিকে ইউনাইটেড কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে তখন ধুঁকছে। দশ ম্যাচে মাত্র দুটি জয় নিয়ে লিগ তালিকায় একেবারে শেষের দিকে। টানাটানি পড়ে গেছে বাসবির চাকরি নিয়ে। তারই ফাঁকে আয়োজিত হল তৃতীয় প্রীতি ম্যাচ। বাসবির দলের জন্য এবারও জয় লেখা ছিল না। ৩-২ গোলে হারলেও তাদের সাহস আর উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সংবাদপত্রগুলি। না, তাদের অনুমানে কোনো ভুল ছিল না। প্রথমে ওল্ড ট্রাফোর্ডে তারা রিয়ালকে হারায় ৩-১ গোলে। তারপর ১৯৬২ সালে রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়ামে ৮০০০০ দর্শকের সামনে ইউনাইটেড জেতে ২-০ গোলে। সেই প্রথমবার কোনো ইংলিশ টিম রিয়ালকে তাদের ঘরের মাঠে হারানোর কৃতিত্ব অর্জন করে। 

সেই জয়ের আত্মবিশ্বাসেই ১৯৬২-৬৩ সালে ইউনাইটেড জিতে নেয় এফএ কাপের খেতাব। ‘মিউনিখ ডিজাস্টার’-এর পরে এই প্রথমবার কোনো সাফল্য এল ক্লাবের ঘরে। বিধ্বস্ত অতীত ভুলে শুরু হল নতুন পথচলার পালা। যেন ফিনিক্স পাখির মতো মৃত্যুর দাবানল থেকে আগুনে স্বপ্ন নিয়ে জন্মান্তর হল ইউনাইটেডের। যেন আক্ষরিক অর্থেই সার্থক হল তাদের ‘রেড ডেভিল’ তকমা। আবারও এক তরুণ দল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন ম্যাট বাসবি। জাতিস্মরের মতো ফিরে এল ‘বাসবি বেবস’। পুরনো সঙ্গী বলতে রইলেন ববি চার্লটন। ১৯৬৮ সালে ইউরোপিয়ান কাপের সেমিফাইনালে ফের দেখা হয়ে গেল দুই বন্ধুর। প্রীতির আবহ ছেড়ে এবার লড়াই ইউরোপ সেরা হওয়ার। আর সেবার দুই পর্বের ম্যাচ মিলিয়ে ৪-৩ গোলে রিয়াল মাদ্রিদকে হারায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ফাইনালে একতরফা লড়াইয়ে তারা উড়িয়ে দিল বেনফিকাকে। ২ গোল করলেন ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ চার্লটন। 

তারপর আরওয়েল আর মানজানারেস নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। সাফল্য-ব্যর্থতা সঙ্গী করে দুই ক্লাব বজায় রেখেছে নিজস্ব দাপট। দুঃসময় তো সময়েরই বন্ধু। যেমন বর্তমান সময়ে পালাবদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই আশ্রয়কে। যার হাত ধরে তারা আবার স্বমহিমায় ফিরে আসতে পারে। সেদিন আবার স্বপ্নের নাট্যশালা জুড়ে ধ্বনিত হবে সেই বিখ্যাত উচ্চারণ, “গ্লোরি গ্লোরি ম্যান ইউনাইটেড।”

......................

#Manchester United #Real Madrid #Club Football #Matt Busby #Alex Ferguson #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

77

Unique Visitors

183089