ফিচার

আইনি হত্যা : সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচার

সুদেব বোস Mar 10, 2021 at 4:20 am ফিচার

মিছিল নগরী কলকাতার মানুষ প্রথম পথে নেমেছিল কবে?
উত্তর আমাদের অজানা। তবু ইতিহাসের আবছা আলোটুকু নিয়ে খোঁজার চেষ্টা করা যাক। হয়তো সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো যেতে পারে।

খিদিরপুরের কাছে কুলিবাজার বলে একটি অঞ্চল ছিল কলকাতার প্রথম যুগে। ১৭৭৫ সালের ৫ই আগস্ট সেখানে ঢল নেমেছিল হাজার হাজার মানুষের, তাদের কান্না আর হাহাকারের প্রতিধ্বনি হয়তো বহুদূর অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। হয়তো বা বীরভূমের ভদ্রপুর গ্রামেও।

কারণ ঐ গ্রামের স্বনামধন্য পুরুষ মহারাজ নন্দকুমারকে সেদিন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।ভারত সাম্রাজ্যের সুপ্রীম কোর্টের প্রথম বিচার! প্রথম মৃত্যুদণ্ড! এমনই সে বিচারের মাহাত্ম্য যে Henry Beveridge-এর এ সম্পর্কে বিশেষণ প্রয়োগ– “A judicial murder!” 

পলাশির লুন্ঠন ইংরেজদের কোষাগার যেমন উপচে দিয়েছিল তেমনই বেশ কিছু এদেশীয়র ভাঁড়ারও ভরে দেয়। শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেব এঁদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নন্দকুমারও মোটামুটি সেই তালিকাতেই পড়বেন। আরবি-ফারসি শিখে সরকারি উচ্চপদ, খাজনা আদায়ের অধিকার এমনকী ১৭৬৪ সালে ‘মহারাজ’ উপাধি লাভ !  নিয়তির নির্মম পরিহাস না ঘটলে হয়তো তাঁর নামেও একটা বনেদী বংশ গড়ে উঠত। সিরাজের পরাজয়ে তাঁর সাগর-বন্ধনে কাঠবিড়ালির মতোই অবদান ছিল। শোনা যায় ক্লাইভের কাছ থেকে শেঠ উমিচাঁদ মারফত তিনি বারো হাজার টাকা ঘুষ নেন। এ কথার সত্যতা নিয়ে সংশয় থাকলেও ঐতিহাসিক ঘটনা এটাই যে চন্দননগরমুখী ইংরেজ সেনাকে আটকানোর কোনও  চেষ্টাই তিনি করেননি। তখন তিনি হুগলীর ফৌজদার এবং খুব দ্রুত সে এলাকার কালেক্টরও হবেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পলাশীর পরাজয়ের প্রথম সিঁড়ি গাঁথা হয়েছিল চন্দননগর দখল দিয়ে।

ক্লাইভের সঙ্গে নন্দকুমারের যা ছিল তা শুধু সুসম্পর্ক নয়, সখ্যও বটে। ১৭৫৭-এর আগস্টে তিনি বর্ধমান-হুগলী-নদীয়ার কালেক্টর, বিশাল পরিমাণ অর্থ জমা পড়ে তাঁর হাতে। আবার ১৭৬৪ সালে ক্রীড়নক মীরজাফরকে যখন সিংহাসনে বসানো হল তখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী। তখন অবশ্য তিনি জেনে গেছেন দরবারের যুবক রেসিডেন্ট সাহেব তাঁর পরম শত্রু। নামটি তাঁর ওয়ারেন হেস্টিংস!


আমাদের আজকের কাহিনির আসল অংশটা এখানেই। ক্লাইভের সঙ্গে সুসম্পর্কের সঙ্গেই জড়িয়েছিল হেস্টিংসের সঙ্গে শত্রুতা। রাজস্ব আদায় দিয়ে তার শুরু। কর্তৃত্বের অধিকার নিয়ে সেই বিরোধ বেড়ে ওঠা। আর জালিয়াতির মামলায় শেষ। নন্দকুমার আর হেস্টিংস পরস্পরের বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহণের মামলা করেন। যদিও তাতে কোনও ফল হয় না এবং নন্দকুমার বেকসুর খালাস পান। প্রতিশোধস্পৃহ হেস্টিংস এরপর এমন একটি চাল দিলেন যাতে বহু আগে তামাদি হয়ে যাওয়া একটি আর্থিক তছরূপের জালে আটকে গেলেন মহারাজ।

বলাকী দাস নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ৪৮০২১ টাকার লেনদেনের একটি দলিল সম্পাদন করছিলেন নন্দকুমার। সে লেনদেন মিটে যাওয়ার পর দলিলটা বাতিল হয়ে যায় এবং মেয়র্স কোর্টের মহাফেজখানায় পড়ে থাকে। হেস্টিংস সেটা উদ্ধার করে এই মর্মে মামলা ঠুকলেন যে নন্দকুমার কোম্পানির কোষাগার সংক্রান্ত আর্থিক জালিয়াতিতে যুক্ত। প্রকৃত সুবিচার হলে এ মামলা হয়তো দাঁড়াতই না। কিন্তু ততদিনে হেস্টিংসের হাতে এসে গেছেন তাঁর পরম বন্ধুর সহযোগিতার আশ্বাস। সুপ্রিম কোর্টের প্রথম চিফ জাস্টিস, স্যার এলিজা ইম্পে।

১৭৭৫ সালের জুন নাগাদ নন্দকুমার কারারুদ্ধ হন এবং সেই বিখ্যাত বিচারের সূচনা হয়। বাংলায় আইনি অন্যায়ের সেটাই বোধহয় শুরু। এসপ্ল্যানেডে তখন নিউ কোর্ট হাউস সবে তৈরি হচ্ছে, তাই এ বিচার হয়েছিল মেয়র্স কোর্টে অর্থাৎ আজ যেখানে সেন্ট অ্যাণ্ড্রুস চার্চ তার ঠিক উলটো দিকে। সেখানে ৮ই জুন যে মামলাটি ডাকা হল তার শিরোনাম - “The King v. Nuncoomer”.

২৪৫ বছরের পুরনো এই মামলার জুরিদের তালিকাটি দেখে সবচেয়ে অবাক হতে হয় এটা ভেবেই যে এই মামলান দিন কীভাবে চলেছিল। জুরিদের মধ্যে একজনও এদেশীয় নেই, বরং সিংহভাগ ইংরাজ-অনুগামী। বিচারটি কেমন হয়েছিল? “A great quantity of contradictory swearing and the necessity of having every word of the evidence interpreted, protracted the trial of a most unusual length.”  মেয়র্স কোর্টে ন দিন ধরে চলা এই মামলায় নন্দকুমারের সবচেয়ে বড় অন্তরায় ছিল ভাষা সমস্যা, তাই অসহায় মহারাজ সবটাই ছেড়ে দিয়েছিলেন ভাগ্যের হাতে। প্রকাশ্য বিচারসভায় কাঠগড়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাঁকে ডাকা হলে তিনি স্বগতোক্তির স্বরে শুধু বলেছিলেন - “আমি নির্দোষ”।  পরের প্রশ্ন হল কার দ্বারা তিনি নিজের বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন? বিধ্বস্ত রাজার উত্তর ছিল - “ঈশ্বর ও তার সমতুল্য ব্যক্তিদের দ্বারা”।

তখন তাঁর বয়স সত্তর। জেলখানায় নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ হিসেবে তাঁর পক্ষে জলগ্রহণ সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে শিকার যাতে কোনোভাবেই হাত ছাড়া না হয় তাই জুরিরা আলাদা বাড়ির অনুমতি দিলেন না। একটি অস্থায়ী তাঁবু খাটিয়ে তাঁকে রাখা হল জেল চত্বরেই। সেখানেই হয়তো একটু একটু করে শেষ হয়ে আসছিল তাঁর জীবনীশক্তি। অথবা দূরদর্শী নৃপতি বুঝেছিলেন, “his exertion would be fruitless as the court were decidedly his enemies”. বণিকের মানদণ্ড যখন রাজদণ্ডের রূপ নিয়েছে তখন একজন সামান্য নেটিভের লড়াই যে টিকবে না তা তো বলাই বাহুল্য। মনে রাখতে হবে হেস্টিংস তখন বকলমে ভারতের সর্বেসর্বা আর ইমপে ভারতের সর্বোচ্চ আইনরক্ষক। আর বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের বক্তব্য – “Hastings was the real mover of the business”.

৫ ই আগস্ট ফাঁসির আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই স্বদেশীয় সমাজ করেছিল। কলকাতার নামী নেটিভরা যেমন শেখইয়ার মহম্মদ, কৃষ্ণজীবনদাস তাঁর পক্ষে সাক্ষী দেন। দলে দলে মানুষ তাঁকে জামিন দেবার দাবি জানান। অনড় বিচারক দল তাতে কর্ণপাত করেননি। রাজার হয়ে লড়ছিলেন বিচারক চেম্বার্স। তিনি বিলেতে রাজার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি জানিয়ে স্থগিতাদেশ চাইলেন। এককথায় খারিজ হয়ে গেল সেই দাবি।

নির্ধারিত দিনে ইষ্টমন্ত্র জপ করতে করতে ফাঁসিকাঠে গলা দিলেন স্বনামধন্য নরপতি। শুধু জেনে নিলেন যে তাঁর মৃতদেহ সরাবে সে ব্রাক্ষ্মণ কিনা!

অলক্ষ্যে বিজয়ীর হাসি হাসলেন হেস্টিংস!

“ব্রক্ষ্মনাশ হয়ে গেল কলিকাতার মাঠে/ ফাঁসি হবে শুনে লোক লাগিল ছুটিতে”- এই ঘটনার পাঁচ বছর পর ভারতে প্রথম সংবাদপত্র বেরোচ্ছে। তাই এই বিচারবিভাগীয় হত্যাকাহিনি কখনো প্রতিবেদনের আকারে প্রকাশ পেল না। কিন্তু যে অসংখ্য দেশবাসী তাঁদের সর্বজনমান্য রাজার এই হত্যাকাণ্ড দেখে চিৎকার করে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পাপস্খালন করতে চেয়েছিল তাদের কথা রয়ে গিয়েছিল উত্তরকালের স্মৃতিতে। একশো বছরেরও বেশি সময় পরে হেনরি বেভারিজ যে বই লিখলেন তার নাম - ‘The trial of nandakumar’. সে বইতে দ্বর্থ্যহীন ভাষায় স্বজাতির এই ষড়যন্ত্রের সমালোচনা করলেন। সেটা ১৮৮৬ সাল। তার অনেক আগেই অবশ্য প্রিভি কাউন্সিল এই আইনি জালিয়াতির অভিযোগে হেস্টিংস এবং ইমপে সাহেবকে ইমপিচ করেছিল। দুজনকেই প্রকারান্তরে হত্যাকারী বলেছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে। হ্যাঁ, মেকলে মিনিটসের সেই বিখ্যাত রচয়িতা, তাঁর ‘Essays on Warren Hastings’ বইতে।

আর পড়ুন : ফ্যানি পার্কসের কলকাতা / সুদেব বোস 

গঙ্গা দিয়ে গত আড়াইশো বছরে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। আজ মনে হয় নন্দকুমার শুধু প্রতিহিংসার শিকার নন, একজন আপাদমস্তক হতভাগ্যও বটে। কারণ? তাঁর হাত ধরার জন্য কোনও রামমোহন বা দ্বারকানাথ ছিলেন না। বীরসিংহ-তনয়ের পাঠানো টাকায় সুদূর ফ্রান্সেও জেলে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন মধুকবি। অন্যদিকে নন্দকুমারকে বাঁচানোর সামান্যতম চেষ্টাও করেননি তৎকালীন কলকাতার অঘোষিত কোটিপতি নবকৃষ্ণ দেব।

করবেনই বা কীভাবে! নবকৃষ্ণ ক্লাইভের মুনশি হলেও হেস্টিংসেরও অনুগত ছিলেন।

খিদিরপুরের সেই ফাঁসিমঞ্চ তো নেই-ই, এমনকী কুলিবাজার জায়গাটিও মানচিত্রে দেখায় না। তবু সেই হত্যাকাণ্ডের স্থানটি খুঁজে বার করেছিলেন জনৈক প্রতিবেদক অসিত দাস, একটি ছোট লেখাও লিখেছিলেন ‘প্রতিদিন’-এর ‘রোববার’ সাপ্তাহিকে। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি, ভিক্টোরিয়া থেকে হাইকোর্ট ব্রিটিশ স্থাপত্যের কত চিহ্নই কলকাতা তার শরীরে ধরে রেখেছে। এমনকী সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে সযত্নে রক্ষিত আছে এলাইজা ইমপের সমাধিসৌধ। উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে দাঁড়িয়ে হেস্টিংস হাউসও। ক্লাইভের বিশাল মূর্তি রয়েছে ভিক্টোরিয়ার ভিতরের মিউজিয়ামে। এঁরা সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ‘পলাশীর লুন্ঠন’-এর সঙ্গে জড়িয়ে, যা সম্ভবত বিশ্ব-ইতিহাসের বৃহত্তম আর্থিক জালিয়াতি।

ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সর্বপ্রথম বিচার বা ‘শিকার’ হওয়া প্রজাবৎসল মহারাজ নন্দকুমারের জালিয়াতির অঙ্ক তো মাত্র আটচল্লিশ হাজার। তাই বোধহয় স্মৃতিসৌধ তাঁর পাওনা হয়নি। 

........................


#মহারাজা নন্দকুমার #Maharaja Nandakumar # hanging # Elijah Impey # British Parliament #judicial murder #ফাঁসি #আইনি হত্যা #মৃত্যুদণ্ড #পলাশী লুণ্ঠন #নবকৃষ্ণ দেব #এলিজা ইম্পে # Warren Hastings #ওয়ারেন হেস্টিংস #সুদেব বোস #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

57

Unique Visitors

183244