নিবন্ধ

প্যারীচরণ সরকার -- এক বিস্মৃতপ্রায় মনীষী

মণিমেখলা মাইতি Jan 23, 2021 at 3:54 am নিবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ছেলেবেলা'য় লিখছেন—“তখন শহরে না ছিল গ্যাস, না ছিল বিজলি বাতি।...সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ঘরে ফরাস এসে জ্বালিয়ে যেত রেড়ির তেলের আলো। আমাদের পড়ার ঘরে জ্বলত দুই সলতের একটা সেজ।

মাস্টারমশায় মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্ট বুক। প্রথম উঠত হাই, তারপর আসত ঘুম..."

কে এই প্যারী সরকার আর কী বা এই 'ফার্স্ট বুক', তা সম্পর্কে আজ বাঙালিদের মধ্যে যথেষ্ট ধোঁয়াশা আছে। প্রত্যেকটি বাঙালি বাড়িতে এখনও 'বর্ণপরিচয়'-এর কদর থাকলেও 'বর্ণপরিচয়'-এর পাঁচ বছর আগে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক প্যারীচরণ সরকারের লেখা ' ফার্স্ট বুক রিডিং'-এর কথা বাঙালি ভুলে গেছে। কারণ এই ইংরেজি প্রাইমারটি আর পড়ানো হয় না। বাঙালি মনে রাখেনি প্যারীচরণ সরকারকে।

 প্যারীচরণ সরকারের জন্ম ১৮২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার চোরবাগান অঞ্চলে। তাঁর পিতা ভৈরবচন্দ্র সরকার। মা দ্রবময়ী দেবী। আদতে প্যারীচরণ সরকার হুগলি জেলার লোক। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল হুগলি জেলার 'তড়া' গ্রামে। এবং তাঁদের বংশের প্রকৃত পদবি ছিল 'দাস'। 'সরকার' হল নবাবের কাছ থেকে পাওয়া উপাধি। 

 রীতিমতো শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন প্যারীচরণ সরকার। তাঁর পঠনপাঠন শুরু হয় ঠনঠনিয়ার কালী মন্দিরের উল্টোদিকে ডেভিড হেয়ারের পাঠশালায়। এরপর তিনি চলে যান ঢাকায়। কারণ তখন প্যারীচরণের বড়দা পার্বতীচরণ ঢাকা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। হিন্দু কলেজের অন্যতম কৃতী ছাত্র পার্বতীচরণ সরকার ছিলেন ডেভিড হেয়ারের প্রিয় পাত্র। বছরখানেক ঢাকায় থেকে প্যারীচরণ পুনরায় কলকাতা চলে আসেন এবং ভরতি হন ডেভিড হেয়ারের পটলডাঙা ইংরেজি স্কুলে। এখন কলেজ স্কোয়ারের যে কোণে কর্পোরেশনের অফিস, ডেভিড হেয়ারের স্কুলটি তখন ওখানেই ছিল। অত্যন্ত কৃতী ছাত্র ছিলেন প্যারীচরণ সরকার। শুধু মেধার জন্য নয়, চারিত্রিক বিশিষ্টতার জন্যও হেয়ার সাহেবের নজর কেড়েছিলেন প্যারীচরণ। এই স্কুল থেকেই বছরে তিরিশ জন করে ছাত্র হিন্দু কলেজে যেত। জুনিয়র স্কলারশিপে ভালো ফলাফল করে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজের তৃতীয় শ্রেণিতে ভরতি হন প্যারীচরণ। ১৮৪১-১৮৪৩ এই পরপর তিন বছর তিনি সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান দখল করে মাসে চল্লিশ টাকা করে বৃত্তি পান। হিন্দু কলেজে তাঁর সহপাঠীরা ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখ। তা ছাড়া ১৮৪০-এ ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানস্পৃহা বাড়ানোর জন্য ডি. পি. আই যে লাইব্রেরি পদক পরীক্ষার আয়োজন করেছিল, সেই পরীক্ষায় স্বর্ণপদক পান প্যারীচরণ সরকার। 

 ১৮৪৩-এ পরিবারে নেমে এল বিপর্যয়। ভৈরবচন্দ্রের মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব ছিল যাঁর কাঁধে, সেই বড়দা পার্বতীচরণ সরকারের মৃত্যু হল আচমকা কলেরায়। তখন পার্বতীচরণ হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এত বড় পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য পড়াশোনায় ইতি পড়ল প্যারীচরণের। ১৮৪৩-এর ১০ ডিসেম্বর হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলেই দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে চাকরি নিলেন। এখান থেকেই শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্যারীচরণ সরকারের। সে খবর সরকারের কাছে পৌঁছেছিল। তাই সরকার যখন বারাসাতে একটি স্কুল করার কথা ভাবেন, স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন প্যারীচরণ সরকার, ১৮৪৬-এর ১ জানুয়ারি।

আরও পড়ুন : বিস্মৃত অক্ষর: কথাসাহিত্যিক সরোজকুমার রায়চৌধুরী / প্রতিষ্ঠা আচার্য

 স্কুলের দায়িত্ব নিয়ে আমূল বদলে ফেলেন স্কুলটিকে। গড়ে তোলেন বিদ্যালয়ের নিজস্ব বাড়ি, ছাত্রাবাস। চালু করেন কৃষিবিদ্যা শ্রেণি যাতে ছেলেরা চাষবাসে আকৃষ্ট হয়, স্থাপন করেন বেথুন সোসাইটির শাখা। স্কুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এরপর ১৮৫৪ সাল নাগাদ তিনি বদলি হয়ে চলে আসেন কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে, যা পরে হেয়ার স্কুলে পরিণত হয়। এই সময় তিনি কলকাতায় ছাত্রদের থাকার সুবিধের জন্য কলকাতায় বাড়িভাড়া নিয়ে একটি ছাত্রাবাসের সূচনা করেন, যার বর্তমান নাম 'হিন্দু হোস্টেল'। শিক্ষক হিসেবে প্যারীচরণের খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। তিনি ইংরেজি সাহিত্য, ব্যাকরণ, পাটিগণিত, ভূগোল পড়াতেন কলুটোলায়। ১৮৬১তে অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত হলেন প্রেসিডেন্সিতে ইতিহাস ও পলিটিক্যাল ইকনমির অধ্যাপক হিসেবে। ইংরেজির স্থায়ী অধ্যাপক হলেন ১৮৬৭তে। প্রেসিডেন্সির ইতিহাসে প্যারীচরণ সরকার প্রথম বাঙালি ইংরেজির অধ্যাপক।

 বারাসাতে পড়ানোর সময়ই প্যারীচরণ সরকার দেখেন যে ছাত্রদের পড়ানোর মতো ভালো কোনও ইংরেজি প্রাইমার নেই। ছাত্রদের সুবিধার্থে ১৮৫০-এ তাই লিখলেন 'ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিভ চিলড্রেন'। বাকিটা ইতিহাস। বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদৃত হয় এই প্রাইমার। সম্ভবত পরের বছরই বেরোয় 'সেকেন্ড বুক অফ রিডিং'। সেটিও সমান জনপ্রিয় হয়। পর পর বেরোতে থাকে 'থার্ড বুক অফ রিডিং', 'ফোর্থ বুক অফ রিডিং', 'ফিফথ বুক অফ রিডিং', ' সিক্সথ বুক অফ রিডিং'। ভূগোলের ওপর বেশ কয়েকটি বই লেখেন তিনি। চোরবাগানে 'স্কুল বুক প্রেস' নামে তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা ছিল। বারাসাতে প্যারীচরণ সরকারের আরেকটি অবদান, স্থানীয় বিশিষ্টজন কালীকৃষ্ণ মিত্র, নবীনকৃষ্ণ মিত্রর সাহায্যে ১৮৪৭ -এ ভদ্রবাড়ির মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল তৈরি। সম্ভবত সারা ভারতবর্ষেই অ-মিশনারিদের তৈরি প্রথম মেয়েদের স্কুল এটি। স্কুল স্থাপনের পর প্রাণ সংশয় হয়েছিল প্যারীচরণদের। ডাকাত দিয়ে মেরে ফেলার চক্রান্ত হয়েছিল। তবু দমে যাননি তাঁরা। পরে এই স্কুল দেখেই বেথুন উদ্বুদ্ধ হয়ে কলকাতায় গড়ে তোলেন বেথুন স্কুল।

 শুধু এই একটা স্কুল করেই ক্ষান্ত থাকেননি প্যারীচরণ। মেয়েদের শিক্ষার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ১৮৬৮-এ (মতান্তরে ১৮৬৩-তে) কলকাতার চোরবাগানে, তখনকার ৪৫ নং মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন 'চোরবাগান বালিকা বিদ্যালয়', যাতে বাড়ির বিবাহিত মেয়েরা বা সাধারণ মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে। সে স্কুল রীতিমতো বেথুন স্কুলের সঙ্গে পাল্লা দিত সে যুগে। অন্তঃপুর-শিক্ষারও ব্যবস্থা ছিল। এই স্কুল করতে গিয়েও প্রবল বাধা পেয়েছিলেন, একঘরে হয়েছিলেন। তবু চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ১৮৭৫-এ প্যারীচরণ সরকারের তত্ত্বাবধানে এবং তাঁর ভাইপো ডাঃ ভুবনমোহন সরকারের সম্পাদনায় চোরবাগান বালিকা বিদ্যালয় থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিল সাধারণ মেয়েদের জন্য পত্রিকা 'বঙ্গমহিলা'। দুবছর চলেছিল পত্রিকাটি। বহু মহিলা নামে-বেনামে কলম ধরেছিলেন। সেই স্কুল কলকাতার বুকে এখনো বিদ্যমান। চোরবাগানে ছাত্রদের জন্য আরেকটি ইংরেজি প্রিপারেটরি স্কুল করেছিলেন প্যারীচরণ। পরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন হলে সে স্কুল বন্ধ করে দেন তিনি।

 সুপণ্ডিত প্যারীচরণ সরকার শুধুমাত্র যে শিক্ষাসংস্কারক ছিলেন তা নয়, সমাজসংস্কারকও ছিলেন। বিদ্যাসাগরের অভিন্নহৃদয় বন্ধুটি যেমন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বিধবাববাহ, বহুবিবাহ রদ আন্দোলনে প্রথম থেকেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তেমনি তিনি গড়ে তুলেছিলেন মদ্যপান নিবারণী আন্দোলন। ১৮৬৩-তে গড়ে তুলেছিলেন 'বঙ্গীয় সুরাপান নিবারণী সভা' বা Bengal Temperance Society। মদ্যপানের কুফল বোঝাতে ১৮৬৫-তে প্রকাশ করেন 'ওয়েল উইশার' পত্রিকা। আরেকটি পত্রিকা বের করেন 'হিতসাধক' নামে। তখন সমাজে রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছিল এ আন্দোলন।

আরও পড়ুন : একটি হিমশীতল স্বীকারোক্তি : শামশের আনোয়ারের কবিতা / আহ্নিক বসু  

 অসাধারণ দানবীর ছিলেন প্যারীচরণ সরকার। বন্ধু বিদ্যাসাগরের থেকে কোনও অংশে কম ছিলেন না। তাঁর ডান হাতের সেবা বাম হাত জানত না। কত গরিব ছাত্র, বিধবা মহিলা, পঙ্গু লোক, অসুস্থ ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত সাহায্য পেত তার ইয়ত্তা নেই। তখনকার দিনে মাসে তিন চার হাজার টাকা আয় হত তাঁর, তবুও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। ১৮৬৬-তে যখন বাংলা ও ওড়িশায় প্রবল দুর্ভিক্ষ হয় তখন মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে নিজের বাড়ির উলটোদিকে 'চোরবাগান অন্নছত্র' খুলে প্রতিদিন প্রায় নশো লোককে খাওয়াতেন। বিধবাবিবাহ তহবিলে নিয়মিত টাকা দিতেন। বিদ্যাসাগরের বিপুল ঋণ শোধ করার জন্য উদ্যোগী হতে গিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও, বিদ্যাসাগর দরকারে নির্দ্বিধায় হাত পাততেন তাঁর অনুজ বন্ধুটির কাছে। দুজনের সখ্য ছিল শেষ দিন পর্যন্ত।

 ব্যক্তিগত জীবনে সহজ, সরল, সৎ ছিলেন প্যারীচরণ। খেতে ভালোবাসতেন। চর্চা করতেন হোমিওপ্যাথির, গানবাজনারও। সাত ছেলে ও ছয় মেয়ের শুধু পিতা ছিলেন না, সমস্ত ভাইপোদের নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছেন। প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেছেন। ১৮৭৫-এ বিডন স্ট্রিটে নিজের বাড়িতে বাগানে কাজ করতে গিয়ে আঙুলে চোট পান এবং মধুমেহ রোগের জন্য আঙুলে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। ভাইপো ডাঃ ভুবনমোহন সরকার অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি কাকাকে। ১৮৭৫- এর ৩০ সেপ্টেম্বর জীবনপ্রদীপ নিভে যায় বাংলার 'Arnold of the East'-এর। তাঁর জন্মদ্বিশতবর্ষ প্রায় সমাগত। তিনি এখন বিস্মৃতপ্রায়। আমরা কি এখনো তাঁকে ভুলেই থাকব?


তথ্যঋণ:

১) প্যারীচরণ সরকার (২০০১) -- স্বপন বসু

 ২) প্যারীচরণ সরকার ( জীবনবৃত্ত) -- নবকৃষ্ণ ঘোষ।

৩) বঙ্গমহিলা -- অখণ্ড প্রতিলিপি সংস্করণ(২০১৮)। 

 

......................................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস] 
#শিক্ষাবিদ #সমাজসংস্কারক #পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা #'ফার্স্ট বুক' #প্রাচ্যের আর্নল্ড #হিন্দু কলেজ #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #ছেলেবেলা #ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর #ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিভ চিলড্রেন #সেকেন্ড বুক অফ রিডিং #স্কুল বুক প্রেস #বাংলা প্রাইমার #স্কুল বুক প্রেস #Bengali Primer #মণিমেখলা মাইতি #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

14

Unique Visitors

183632