নিবন্ধ

সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ: তথ্য? না সত্য?

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী Sep 19, 2020 at 5:13 am নিবন্ধ

............................................................

হিরে মানিক জ্বলে : দশম পর্ব

............................................................


না, এই লেখাটি ‘চারুলতা’, ‘তিনকন্যা’ বা ‘ঘরে বাইরে’ সম্বন্ধীয় নয়। বরং, যা নিয়ে কম কথা হয় তুলনামূলক, ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সেই তথ্যচিত্র নিয়েই আমাদের আজকের আলাপচারিতা। 

এখন বিষয় হল, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ডকুমেন্টারিতে দেখানো সংক্ষিপ্ত রবীন্দ্রজীবন নিয়ে নতুন করে আলোচনা কি সম্ভব? তথ্যচিত্রের নামেই স্পষ্ট, তার কাজ তথ্য দেওয়া, বা ডকুমেন্ট করা। তার মধ্যে ঐতিহাসিক সত্য ছাড়া আর কী বা থাকতে পারে! অতএব, এই তথ্যচিত্র সম্বন্ধে যে কোনও আলোচনাকে কেবল রবীন্দ্র-জীবনকে জানার বেড়াজালে আটকে দিতে পারি আমরা স্বভাবতই। কিন্তু খবরের কাগজের dissemination of facts-এর সঙ্গে কি সত্যজিতের তথ্যচিত্রের কোনও পার্থক্যই নেই? সামান্য ধৈর্য নিয়ে তাকালেই দেখা যাবে, তথ্যসঞ্চয়ের তলে তলে সত্যজিতের এক অন্য অন্বেষণ চলেছে এই কাজটি জুড়ে। সহজলভ্য রবীন্দ্রজীবনের বিশাল বপু, এবং আপাত অবিন্যস্ত তথ্যপুঞ্জের গভীরে সত্যজিৎ তৈরি করছেন রবীন্দ্রবোধের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসর। তাঁর মননে ধরা-দেওয়া রবীন্দ্র-অস্তিত্বের নির্যাস। বিক্ষিপ্ততার কেন্দ্রে থাকা একপ্রকার মূলগত সামঞ্জস্য বলতে পারি একে আমরা। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ আশি বছরের জীবনপ্রবাহে নানা ঘটনার মধ্যে যেমন সংগতির সূত্র নিহিত আছে, তেমনি অনেক অসংগতি বা অসামঞ্জস্যও আছে নিশ্চিত। সেইসব মিল-অমিল পেরিয়ে সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ আরও গভীর কোনও জীবনসত্যে বাঁধা কি? আজ, সেটুকু কথাতেই সীমায়িত থাকবে আমাদের আলোচনার পরিধি। 

সত্যজিতের তথ্যচিত্রটি একান্ন মিনিটের সামান্য কিছু বেশি সময় ধরে চলে। আসুন, এই সামান্য ‘রানিং টাইম’-কে আমাদের অন্বেষণের প্রথম অস্ত্র করি। খুব সহজেই ছবিটিকে ভেঙে ফেলা যায় কমবেশি দশ মিনিটের পাঁচটি করে পর্বে। এই পর্বভাগ প্রয়োজন কেন? কারণ, আপাতভাবে যে সব দৃশ্য বা ঘটনাকে ইচ্ছেমত খাবলে-খুবলে বেছে নিয়ে সাজিয়ে দেওয়া কিছু বিচ্ছিন্ন ধারণা মনে হতে পারে এই ছবিতে, পর্ববিন্যাস তাকে ভুল প্রমাণ করে। এক নতুন সংযোগ, সামঞ্জস্য তুলে আনে বিসদৃশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে। নিছক তথ্যের সমাবেশ ছাপিয়ে আরেক ডিজাইন ধরা পড়ে, উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। 

প্রথাগত নাট্যধর্মী কাহিনির exposition অংশটি বেশ ঢিমে তালের হয়, কিছুটা অলস, কিছুটা মূল গল্পের আয়োজনের মতো। সত্যজিতের তথ্যচিত্রের প্রথম দশ মিনিটও অতিক্রান্ত হয় বিষয়ের হাল-হকিকত খোলতাই করতে। ধ্রুপদি সঙ্গীতের আলাপের মতো সে। পঞ্চাশ মিনিটের চিত্রে দশ মিনিট নেহাত কম সময় নয়। কিন্তু নির্দেশকের তাড়া নেই। রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক প্রয়োজনীয় কথা শুরু করার আগে সত্যজিৎ ফিরে যান দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়ে; ঠাকুর-পরিবারের এবং সময়-সমাজের ইতিহাস উন্মোচন করেন। দশ মিনিটের মাথায় কেবল একবার ছোট্ট রবিকে দেখা যায়, জোড়াসাঁকোর বারান্দায় ঘুরতে। অবশ্য এমন প্রেক্ষাপট-নির্মিতি সত্যজিতের অভ্যাস। ১৯৮৭-তে নির্মিত মাত্র আটাশ মিনিটের ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রটির গৌরচন্দ্রিকাও তিনি করেন সুকুমারের দুই পুরুষ আগে ফিরে গিয়ে, হরিকিশোর কামদারঞ্জনকে (পরবর্তীতে উপেন্দ্রকিশোর) দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার সময় থেকে। ‘সিকিম’ তথ্যচিত্রেও একইভাবে, কাহিনি শুরু হয় সেই হিমালয়ের উত্থানকালের কথা বলে, যেন আর পাঁচ মিনিট পেলে নির্দেশক পৃথিবীর শুরুটাও একবার দেখিয়ে দিতেন। সিকিমের অন্দরমহল বা সমাজে ঢোকার আগে সত্যজিৎ দশ মিনিট ধরে সিকিমের ভৌগোলিক ইতিহাস, মানচিত্র, উদ্ভিদ, নদী, ইত্যাদি দেখিয়ে দর্শকের পরিচয় ঘটান সেই ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে, যা আগামী চল্লিশ মিনিট ধরে জুড়ে থাকবে দর্শকের মনোনিবেশের কেন্দ্রবিন্দু। 

রবীন্দ্রনাথের যে দীর্ঘ জীবনকাল, তার প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে তথ্যচিত্রটির পরের চারটি পর্ব মোটামুটি তাঁর দশ থেকে চল্লিশ, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ, পঞ্চাশ থেকে সত্তর এবং সত্তর থেকে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত দেখায় যথাক্রমে। খেয়াল করলে দেখবেন, দ্বিতীয় পর্বের দশ মিনিটে প্রায় ত্রিশ বছর দেখিয়েছেন সত্যজিৎ, প্রথম পর্বের শিথিল শুরুর পর। কবির গড়ে-ওঠার সময় এটি – বাড়ি বসে শিক্ষালাভ বা মহর্ষির সঙ্গে ভ্রমণ হোক, প্রথমদিককার ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ বা ‘সন্ধ্যাসংগীত’ হোক, বিলেতে যাওয়া হোক, বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর সঙ্গে সখ্য হোক –কবিজীবনীতে এই সময়ের গুরুত্ব অসীম। কিন্তু সত্যজিৎ খুঁজছিলেন অন্য কিছু। কেবলমাত্র কবি বা লেখকসত্তার উত্থান দেখিয়ে নিবৃত্তির পথে যাবেন না তিনি। তাঁর লক্ষ্য মানুষ রবীন্দ্রনাথ, কর্মী রবীন্দ্রনাথ, ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ আসা বিশ্ববৃত্তের রবীন্দ্রনাথ। তাই দশ মিনিটে ত্রিশ বছর দেখিয়ে পরের চল্লিশ বছরের জন্য সত্যজিৎ সময় নেন একত্রিশ মিনিট। ১৯০১-এ বোলপুরে জমিদারি দেখাশোনা করতে যাওয়া থেকে যেন রবীন্দ্রনাথের আসল জীবন শুরু হয় সত্যজিতের চোখে। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়-স্থাপন, একের পর এক স্ত্রী-কন্যা-পুত্রের মৃত্যু, তারই মাঝে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যোগদান, রাখিবন্ধন উৎসবের সূচনা – জীবন পসরা সাজিয়ে বসে নিজের। ছবিটির চতুর্থ পর্ব জুড়ে মিলেমিশে থাকে গীতাঞ্জলি, নোবেল ও নাইটহুড প্রাপ্তি, নাইটহুড ত্যাগ, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে শান্তির প্রচার, বিশ্বভারতীর ক্রমবিকাশ প্রভৃতি। 

এইসবের পাশাপাশি ছবিতে কিন্তু প্রভূত পরিমাণে উল্লিখিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের শিল্প-সৃজন। তাঁর কবিতা, গদ্য, গান, নাটকের পাশাপাশি আঁকা ছবির একজিবিশনের কথা থাকছে; বিদেশে নানা ভাষায় তাঁর সাহিত্য অনূদিত হওয়ার খবর থাকছে; থাকছে শিশুসাহিত্যের কথা। এমনকি নতুন নতুন ধরনের বাড়িতে থাকার প্রতি কবির যে ঝোঁক, তারও উল্লেখ থাকছে। প্রতি জন্মদিনে জ্ঞানীগুণীজনের সোৎসাহ উদযাপন প্রমাণ করে দিচ্ছে বাঙালি মানসে তাঁর অবিসংবাদী কর্তৃত্ব। তবু, ‘শেষ হইয়াও’ যেন শেষ হয় না সত্যজিতের প্রতিমা-নির্মাণ। তাঁর লক্ষ্য এই জনপ্রিয় ইমেজকে পুনরায় পালিশ করা নয়! আসলে এইসব বিচ্ছুরণের অতীতে তিনি দেখতে, দেখাতে চাইছেন আরেকটি মানুষকে – এমন একজন, যিনি যতবার খ্যাতি আর যশ লাভ করছেন, প্রতিবার সেইসব-সুদ্ধ নতুন করে জীবনের কাছে আত্মাহুতি দিতে উদগ্র হয়ে উঠছেন। সেইজন্য তথ্যচিত্রের শেষে রবীন্দ্রনাথের মাহাত্ম্য বা মৃত্যুর অলংকার বড় হয়ে উঠছে না সত্যজিতের কাছে। বরং, বাইশে শ্রাবণের আগে, জীবনের শেষ পঁচিশে বৈশাখেই তিনি থামিয়ে দিচ্ছেন গল্প; কথা শেষ করছেন রবীন্দ্রনাথেরই উক্তিতে, যে মানুষ জীবনে দুটো বিশ্বযুদ্ধ, আশি বছর ধরে নিজের দেশের পরাধীনতা, অবজ্ঞা, অন্ধকার, নিজের ব্যক্তিগত ক্ষয়, সব কিছু দেখেও, সহ্য করেও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উচ্চারণ করার ধক রাখেন, “I shall not commit the grievous sin of losing faith in man.”! 

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য তাঁর ‘রবীন্দ্রপ্রোজেক্ট’-এ লিখছেন, “কিছুটা রবীন্দ্রনাথ হয়ে জন্মানো যায়, কিন্তু পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ তিলে তিলে পলে পলে হয়ে উঠতে হয়, তার কঠিন পরিকল্পনা ও অসহ্য শ্রম প্রতিটি, প্রতিটি, প্রতিটি ক্ষণ-খণ্ডে জারি থাকে, এই ধারণার বোধ ও স্বীকৃতি, এবং তুলকালাম আত্মপ্রয়োগ, শুধু এই জন্যই আরও সহস্র বছর তাঁর সূর্যবিভার পানে হাঁ করে থাকতে হবে মনে হয়।” রবীন্দ্রনাথের এই ‘হয়ে-ওঠা’, শঙ্খ ঘোষের ভাষায় যা ‘হওয়ার দুঃখ’, সত্যজিৎ তথ্যচিত্রের তথ্যের অতীতে কি সেখানেই পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন না? 

উল্লেখ্য, ছবিতে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ গানটি তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে – দু-বার তারযন্ত্রে বাজানো, আর একবার কণ্ঠসঙ্গীত আকারে। কী প্রশ্নাতীত প্রতীকী ব্যবহার! ছবির যে অংশে সত্যজিতের আরোপিত গুরুত্ব আপাতভাবে কম মনে হয়, সেখানেই গানটির প্রথম ব্যবহার – মহর্ষির সঙ্গে উত্তর ভারত বেড়াতে গেছে যখন সদ্য-কিশোর রবি, সে সময়ে। লক্ষ করুন, এ সময়েই আধ্যাত্মিকতার প্রথম সংস্পর্শে আসা তাঁর, সুগভীরভাবে – গঠনের এক বিরাট স্তম্ভ। জীবনের আগুনের সঙ্গে সবে পরিচিত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। দ্বিতীয়বার সুরটি ফিরিয়ে আনেন সত্যজিৎ, যখন কবির বয়স ষাটের কাছাকাছি, নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সক্রিয় রাজনৈতিক বাতাবরণ থেকে; মন দিয়েছেন সবরকমের সাহিত্যকর্মে, সম্পাদনায়, এবং নতুন উদ্যমে গড়ে তুলছেন বিশ্বভারতীর শিক্ষাব্যবস্থা। আবারও, নোবেল-প্রাপ্তির পর জীবনে একধরনের সুখাশ্রয় চলে আসার সম্ভাবনাকে ভাসিয়ে দিয়ে নতুন করে গড়ছেন নিজেকে, অন্য রূপে, অন্য পরিচয়ে। তৃতীয় ও শেষবার গানটি ফিরে আসে কবির শেষ বয়সের দিনে। দেহ ভেঙে গেছে; অনেক ছবিতে দেখা যায়, হুইলচেয়ারে বসে চলাফেরা করছেন। শ্লথ হয়েছেন শরীরে; কিন্তু গানের পঙ্‌ক্তিটি আবার তাড়িয়ে বেড়ায় “জীবন যেন দিই আহুতি, মুক্তি আসে”। আবারও কাজের ডাক, আবারও মানুষটি সচল, প্রবৃত্ত। 

অন্তিমে আহুতির, অঞ্জলির অনুষঙ্গ রাখা বোধহয় সত্যজিতের ছবিতে রেকারিং মোটিফ। তাঁর ‘সিকিম’ ছবিটিও শেষ হয় নতুন বছরের শুরুতে ধর্মীয় আচার মেনে খড়ের তৈরি ঘর-দাহের কাহিনি দিয়ে, যার সঙ্গে পুড়ে যেতে থাকে বিগত দিনের সব দুঃখ, কষ্ট, অপ্রাপ্তি, জ্বালা, যন্ত্রণা। মানুষ আবার বুক বাঁধে আশায়। সমস্ত পৃথিবীর যাবতীয় তথ্যের আড়ালে এ-ই বোধ হয় সত্য, মূল সুর – জীবনের জয়গান, আবার, আরও একবার। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ তথ্যচিত্রের শেষে যখন ‘ওই মহামানব আসে’ গানটি শুরু হয়, সমুদ্রের শেষে সূর্য দেখা যায়, তখন জনপ্রিয় ‘বিশ্বকবি’ নন, যে মানুষটি অঞ্জলি দিয়ে, শেষ ফ্রেমে করজোড়ে প্রণাম জানান পৃথিবীকে, তিনিই হয়ে ওঠেন ‘সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ’। অবনত, সহনশীল, সাহসী।  


[কভারে সত্যজিত রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]

#Satyajit Roy #সত্যজিৎ রায় #নিবন্ধ সিরিজ #সিরিজ #Series #হিরে মানিক জ্বলে #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #Rabindranath Tagore #শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী #Documentary on Rabindranath #তথ্যচিত্র

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

53

Unique Visitors

183669