ব্যক্তিত্ব

স্টিফেন হকিং : এক মহাজীবন

সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি Jan 8, 2021 at 9:55 am ব্যক্তিত্ব

“মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে, আমি মানব একাকী বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে...”

স্টিফেন হকিং এর কথা বলতে গেলে প্রথমেই রবিঠাকুরের এই গানটার কথা মনে আসে। দূরদর্শী, প্রাজ্ঞ এই রসিক মানুষটি নিজেকে নিয়েও রসিকতা করতে ছাড়তেন না। নিজেই মজা করে উল্লেখ করেছিলেন আরেক মহাবিজ্ঞানী গ্যালিলিওর জন্মের ঠিক তিনশো বছর পর একই দিনে তাঁর জন্মের কথা। সময়ের অদ্ভুত খেলায় তাঁর মৃত্যুদিনও কিনা সমাপতিত হল আরেকজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানসাধকের জন্মদিনের সঙ্গে। তিনি আর কেউ নন,  অ্যালবার্ট আইনস্টাইন!   

আরও পড়ুন : পোলিওর টিকা : দুজন ভালোমানুষের বিজ্ঞান / স্বপন ভট্টাচার্য

নিজের সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় হারিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে চ্যালেঞ্জের খেলায় মেতে উঠেছিলেন হকিং। জীবন যেন তাঁর কাছে অদৃষ্টের সঙ্গে শতরঞ্জের রোমাঞ্চকর খেল! যখন তাঁর কর্মজীবন সবে শুরু হতে যাচ্ছে, গবেষণা চলছে পুরোদমে, তখনই হঠাৎ মারণ মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন স্টিফেন। ডাক্তাররা প্রায় জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন, শরীরও দ্রুত হার মানছিল, কিন্তু দুটো জিনিস সক্রিয় ছিল তাঁর। দুটি মোক্ষম অঙ্গ, হৃদয় আর মস্তিষ্ক। তাই নিয়েই তিনি লড়ে গেলেন পরবর্তী সুদীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময়! দক্ষ প্রযুক্তিবিদরা তাঁকে সাহায্য করলেন একটি অত্যাধুনিক চেয়ার বানিয়ে দিয়ে, কথা বলার যান্ত্রিক পদ্ধতি রপ্ত করতে হল তাঁকে। অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে ঢাকা পড়ে গেল অজস্র অকেজো স্নায়ুর অক্ষমতা। কাজ, কাজ এবং কাজ – বেঁচে থাকার একমাত্র লক্ষ্য ছিল এটাই। তাঁর জীবন যে কোনও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। হারার আগে হার না মানার শিক্ষা দেবে।


এই সেদিন, বন্ধু রজার পেনরোজ নোবেল পেলেন যখন, তিনি তখন ইহলোকে নেই। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে যুগান্তকারী তাত্ত্বিক গবেষণার বীজটি রোপণ করার ক্ষেত্রে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানও যেন স্বীকৃতি পেল পেনরোজের এই প্রাপ্তির মাধ্যমেই। স্টিফেন উইলিয়াম হকিং! লুকাসিয়ান চেয়ার প্রফেসর, দু’বারের নাইটহুড পাওয়া এই মানুষটির জনপ্রিয়তার সঙ্গে সম্ভবত অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ছাড়া অন্য কারও তুলনা চলে না। আইনস্টাইন জীবনসায়াহ্নে এসে যে ‘গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি’-এর স্বপ্ন অধরা রেখে গেছিলেন, হকিং সাহেবের ‘থিওরি অব এভরিথিং’-এর কারিগর হয়ে ওঠাও যেন সেই রিলে রেসের ব্যাটন হাতে তুলে নেওয়ার মতোই। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তাঁর নামাঙ্কিত ‘হকিং রেডিয়েশন তত্ত্ব’ তাঁকে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি করে তুলেছিল। মহাবিশ্বের হৃদয় সমাহিত ছিল তাঁর অন্তরে। এই বিপুল বিশ্বের মহাজাগতিক স্পন্দন তিনি অনুভব করতেন তাঁর অতীন্দ্রিয় প্রতিভা দিয়ে। তাই সাধারণ মানুষ, বিজ্ঞানের ছাত্ররা তাঁকে একের পর এক প্রশ্ন করে গেছে, আর তিনি একটুও বিরক্ত না হয়ে তাঁর অসামান্য প্রজ্ঞায় অনায়াসে জবাব দিয়ে গেছেন সেসব প্রশ্নের, সমাধান করেছেন জগতের গূঢ় রহস্যের। 

আরও পড়ুন : বিজ্ঞান ও ফ্যাশন – এক অন্যধারার রূপকথা / সায়নদীপ গুপ্ত

তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অজস্র অ্যানিমেশন ছবি, টেলিছবি এমনকি চলচ্চিত্রেও তিনি স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছেন নিজেরই চরিত্রে! কখনও বা তাঁর যান্ত্রিক কণ্ঠটি ব্যবহৃত হয়েছে সুচারুভাবে। নিজের পারিবারিক আর্থিক দুরবস্থার সময়ে বাধ্য হয়েছেন বই লিখে রোজগার করতে। আর সেই বইয়ের নাম? ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ – সম্ভবত বিংশ শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাধারণের জন্য লিখিত বিজ্ঞান গ্রন্থ! যেখানে হাত দিয়েছেন, রেখে গেছেন নিজস্ব স্বাক্ষর। 


কেন তিনি এত জনপ্রিয়? মাত্র কয়েকটা কারণ বলা যায়। ঐশ্বরিক মেধা। তুখোড় রসবোধ। বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সেবক হয়ে মানবসভ্যতার প্রতি তাঁর অবদান রেখে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা, জনকল্যাণের নিমিত্ত নানাবিধ কর্মকাণ্ড, তাঁর সংবেদনশীল মন বারংবার ছুঁয়ে গেছে আমজনতাকে। তিনি নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছেন, মানুষের আসল সম্পদ তার মন। নশ্বর শরীর, জাগতিক যাবতীয় সামগ্রী ধূলায় মিশে গেলেও রয়ে যায় মানুষের নিজস্ব চিন্তাধারা, আগামীর কাছে সঞ্চিত থাকে তার মেধাসম্পদ। একটু একটু করে উন্নতির সোপান চড়ে মানুষ। কিন্তু সেই উন্নয়নের কুফল নিয়েও তিনি প্রায়ই আশঙ্কা প্রকাশ করতেন। এই মানবসভ্যতার আশু ধ্বংসের কথা ভেবে চিন্তিত হতেন মহাবিজ্ঞানী। এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব আর একশো বছরও টিকে থাকবে না হয়ত, আক্ষেপের সুরেই তিনি এ কথা বারবার বলতেন। যেভাবে আমরা প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছি, তা তাঁকে ব্যথিত করত। জানি না, তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হবে কিনা। স্টিফেন হকিং-এর মতো ব্যক্তিরা শতাব্দী নয়, সহস্রাব্দেই একজনও জন্মান কিনা সন্দেহ, তাঁর জীবন ও বোধ থেকে যদি আমরা সামান্য শিক্ষাও নিতে পেরে থাকি, তবে তাই হবে এই মহাজীবনের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য।



#Stephen hawking #Scientist #physicist #cosmologist #Birthday #motor neurone disease #regards #জন্মদিন #শ্রদ্ধা #A Brief History of Time #The Theory of Everything #সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

56

Unique Visitors

182976