নিবন্ধ

পুরনো ‘টিনের তলোয়ার’-এ জং ধরেনি?

রণিতা চট্টোপাধ্যায় 30 days ago নিবন্ধ

সম্প্রতিই মেয়েদের আঁচলের মাপ কী হবে, তা নিয়ে সুশীল সমাজ তোলপাড় হয়ে গেল। যাঁরা বেশ প্রগতিশীল, তাঁরাও কথার আগে ‘ক্ষমা করবেন’ শব্দবন্ধের রক্ষাকবচ জুড়ে এ নিয়ে দু-চার কথা খরচ না করে থামলেন না। উৎপল দত্ত এই সময়ে হাজির থাকলে হয়তো সে কথাটাই তাঁদের ফের মনে করিয়ে দিতেন, লেনিনের প্রসঙ্গ টেনে একসময় যে কথা বলতে তিনি দ্বিধা করেননি। লেনিন নাকি ক্লারা জেটকিনকে বলেছিলেন, অনেক কমিউনিস্টকে নারীজাতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে পড়ে এক-একটি দানব। এই কথা টেনেই ‘জপেনদা জপেন যা’-র উৎপল কমিউনিস্টদের সপাটে বলতে ছাড়েননি, “তোরাও তাই। রোজ দু-চারটে করে নিদর্শন পাই নারী প্রশ্নে তোদের মালিকানার মনোভাবের। ভেতরে ভেতরে তোরা অনেকেই নারীকে মনে করিস সম্পত্তি। নইলে হঠাৎ হঠাৎ আজকের মেয়েদের বেশভূষা নিয়ে দুমদাম অমন মন্তব্য লিখে ফেলিস কেন?” নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীদের মতো প্রতিবাদী বামেরাও যে অনেকেই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবেন, বছর পঞ্চাশ আগেও সে কথা দিব্যি বুঝে নিয়েছিলেন উৎপল। তাই, যে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে তিনি মেয়েদের নানারকমের বিক্রি হয়ে যাওয়াকে তুলে আনতে দ্বিধা করেননি, কোনও প্রতিবাদী নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে সেই ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকেই কোনও যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত ধর্ষণগীতি গাইতে পারেন, এ দৃশ্য দেখলে হয়তো উৎপল দত্ত অবাক হতেন না। এমনকি সে নির্দেশক তাঁরই নাটকের একসময়ের সহকারী পরিচালক হলেও না।


আমরা অবশ্য অবাক হই। অবাক হই, কারণ নিজেদের প্রোপাগান্ডিস্ট বলতেও আমাদের বাধে, আবার প্রোপাগান্ডার নিদারুণ দৈন্যকে মেনে নিতেও সমস্যা হয়। তাই আমরা সেই গড্ডল প্রবাহের শরিক কিংবা দর্শক, যেখানে নিজস্ব রাজনীতি আর বাস্তব কাজের মধ্যে বড় বড় ফাঁক থেকে যায়, আর শিল্পের দোহাই দিয়েই জারি থাকে তাকে মান্যতা দেওয়ার প্রক্রিয়া। সেই প্রবাহ তাই ‘মৃদু প্রগতির ফিসফাসেই’ ঘোরাফেরা করে, ‘টালমাটাল বিপ্লবের কর্কশ হুংকারে’ পৌঁছতে চাওয়ার ঝুঁকি নেয় না। এই সামাজিক প্রবণতাকে উৎপল যেভাবে চিনেছিলেন, নাটকে সেই প্রবণতার ছাপছোপও দেখেছিলেন সেভাবেই। বড়লোকের উঠোন থেকে হাড়ি-শুঁড়ি অর্থাৎ আম লোকের থিয়েটারে পৌঁছনো, মাঝে জনতার থিয়েটারকে ছুঁয়ে গ্রুপ থিয়েটারের গন্তব্য— এই গোটা যাত্রাপথে মেয়ে-মদ-মস্তির সমীকরণ কীভাবে কতখানি কাজ করেছে, সে কথা সকলেই জানেন। কিন্তু বিনোদিনীর নামে ‘বি থিয়েটার’ নাম অব্দি যাঁরা রাখতে পারেন না বা রাখতে চান না, তাঁদের পক্ষে তা নিয়ে কথা বলা কি আদৌ সম্ভব! উৎপল সেই ছুঁতমার্গকে মান্যতা দেননি বলেই তিনি বসুন্ধরা আর ময়নাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন দুই অবস্থানে থেকে, দুরকমভাবে দুজনের ব্যবহৃত হওয়া। আদতে উৎপল দত্তের প্রোপাগান্ডা এমনই বহু স্তর ও বহু মাত্রা নিয়ে নিটোল। সেখানে রাজনৈতিক অসমতার পাশাপাশি লিঙ্গরাজনীতির বানানো অসমতার ঠাঁই হওয়া অসম্ভব হয় না, কারণ প্রকৃতিগত ভাবে দুই-ই অসমতা, আর দুয়ের ক্ষেত্রেই বদল জরুরি। এই বদলের লক্ষ্যটাই উৎপল দত্তের প্রোপাগান্ডা। তিনিই বলেন, ‘I am a propagandist for revolution’, আর নাটক তাঁর কাছে সেই প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার মাত্র। 

আসলে পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও ‘টিনের তলোয়ার’ কেন থিয়েটারে ফিরে আসে, তার উত্তর খুঁজতে গেলে এই প্রোপাগান্ডিস্ট তকমাটাই আমাদের হাতিয়ার হয়। যে উৎপল দত্ত আর্ট ফর আর্ট’স সেকে বিশ্বাসীই নন, তিনি হঠাৎ উত্তাল সত্তরে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক নাটক লিখতে গেলেন কেন, আর এই সময়ের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জোয়ারের মাঝেই বা সে নাটক নিয়ে ফের আগ্রহ তৈরি হয় কেন, এ প্রশ্ন তো উঠবেই। এ নাটকের স্থান ১৮৭৬ সালের মোকাম কলকাতা। যেখানে একদিকে বউবাজার চাঁপাতলা মেছোবাজারে গোরার দল কালো মানুষদের মেরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে, সেই একই সময়ে থিয়েটার দেখাচ্ছে কাশ্মীরের যুবরাজকে নিয়ে ‘ময়ূরবাহন’ নাটক। নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনে এক দলের তাবড় অভিনেতারা গ্রেপ্তার হলেও অন্য দলের নেতা উৎফুল্ল, প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ার আনন্দে। এই দ্বিচারিতা কি স্থান-কাল নির্বিশেষে চিরন্তন নয়? সাম্প্রতিক রাজনীতিতেও বিরোধীদের জোট না বাঁধার ছবিতে এই আত্মকেন্দ্রিকতাই কি ফিরে আসে না? ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সরকার যে নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন লাগু করেছিল, তার কারণও সেই ক্ষমতার বিরুদ্ধে আঙুল তোলা আর আঙুল গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেনা গল্প। আসলে সে বছরই কলকাতায় এসেছিলেন প্রিন্স অফ ওয়েলস, অর্থাৎ ইংল্যান্ডের যুবরাজ। হিন্দু অন্দরমহল দেখার শখ হয়েছিল তাঁর। আর তাঁকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে সে শখ মিটিয়েছিলেন হাই কোর্টের উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়। এই তোষামোদকে ব্যঙ্গ করেই ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার। পুলিশ এ নাটক নিষিদ্ধ করে আর নাম বদলে ফের নাটক মঞ্চে নামে, এ ঘটনা ঘটে বার তিনেক। শেষে ‘দ্য পুলিস অফ পিগ অ্যান্ড শিপ’ নামেই একটি প্রহসন হাজির করে এই দল। সেকালের পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ আর পুলিশ সুপার চার্লস ল্যাম্বকে ব্যঙ্গ করেই এই নামকরণ। তার ফলশ্রুতিতেই নামে গ্রেপ্তারি। সেই নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন যে স্বাধীন ভারতেও বলবৎ, উৎপল দত্ত নিজেই তার ভুক্তভোগী। কখনও ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’-র জন্য পুলিশের মারের মুখে পড়েছেন, কখনও কল্লোল বা তীরের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেই সেন্সরের শাসন যে এখনও অব্যাহত, তার বিস্তারিত খতিয়ান দেওয়া বাহুল্য। আর সেখানেই প্রোপাগান্ডিস্ট উৎপল দত্ত জরুরি, যিনি মনে করতেন কথাগুলো পৌঁছে দেওয়াই সবচেয়ে জরুরি, তা সে যেভাবেই হোক। প্রকট রাজনীতির কথা যদি হারিয়ে যায়, তবে প্রয়োজন একটা আড়ালের। সত্তরের রক্তাক্ত সময় আর শাসকের নিয়ন্ত্রণের কথা বলতে তাই তিনি আড়াল করলেন প্রায় তেমনই একটা সময়কে। কারণ শিল্পের ক্ষেত্রে এহেন নিয়ন্ত্রণও তো চিরন্তন। শাসক কীভাবে শিল্পকে নিজের প্রচারে ব্যবহার করে, সেই ইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটাসের কথা বলেছিলেন আলথুজার। আর যদি শিল্প সেই ব্যবহারে নারাজ হয়? তখনই নামে পালটা আঘাত। 

কিন্তু, যে শিল্প ব্যবহৃত হওয়ার প্রতিবাদ করছে, সেও কি কখনও নিজেই হয়ে ওঠে ব্যবহারকারী? বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস সে কথাও জানে। জানে বিনোদিনীকে ব্যবহার করে স্টার থিয়েটার তৈরির ইতিহাস। এ যুগে আবার নাটক শেখানোর নামে কোনও অভিনেত্রীকে ছুঁয়েছেনে নিতে পারেন খোদ নাট্যগুরুই। সেই দুই যুগের মাঝে সেতু জুড়ে দেয় ময়না-বসুন্ধরারা। আর সেই অতীত থেকে বর্তমান জোড়া সময়ের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যেতে যেতে উৎপল খাড়া করেন কলকাতার তলায় থাকা সেই লোকটাকে। রক্ষণশীলতার শুচিবাইয়ে কিংবা প্রগতির ঢঙে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা-যুক্তি-তর্ক হারানো যে সমাজ এক মহিমান্বিত চণ্ডীমণ্ডপ হয়ে উঠেছে, তার দিকে তারই বর্জ্য ছিটিয়ে দিতে পারে সেই লোকটাই। সেই লোকটাই নবারুণের ফ্যাতাড়ু, যে এবার ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে উঠে বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে যাবে। সে এতটাই বিপজ্জনক রকমের স্পষ্ট যে ‘সাবঅল্টার্ন ক্যান স্পিক’-এর ছাতাতেও তাকে ধরা যাবে না, তাকে বুঝতে গেলে ফিরে যেতে হবে উৎপলের সেই ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ তকমার কাছেই। 

মনে করে নেওয়া যাক, মহাবিদ্রোহের ইতিহাসের  প্রেক্ষিতে ‘টোটা’ নাটক লেখার সময় উৎপল দত্ত বলছেন, নাটকের একটা প্রধান কাজ হচ্ছে অতীতকে সঠিকভাবে মার্ক্সবাদী আলোকে তুলে ধরা। এও তাঁর কাছে একরকমের প্রোপাগান্ডা। বামমনস্কতার ছাঁকনিতে ফেলে আসা সময়কে খতিয়ে নিয়ে তাকে ব্যবহার বা বাতিল করা, আর বাকিটাকে বিপ্লবের ঘানিতে চড়ানো। ‘টিনের তলোয়ার’-এও উৎপল সে কাজটাই করেছিলেন নিপুণ শিল্পীর দক্ষতায়। স্রেফ গল্প বলার কায়দায় সমাজের স্তরে স্তরে থাকা অন্তঃসারশূন্যতাকে টেনে এনেছিলেন। আবার ‘শ্রেণিহীন’ থিয়েটারওয়ালাদের ফাঁপা অবস্থানগুলো স্পষ্ট করে দিয়ে আদতে একটা হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন, যে, ছক ভাঙার মোহেও কোন ফাঁদে পড়া সম্ভব। ‘ওভার্ট’ কথক হয়েও এ নাটকে কাহিনির আড়ালে যে রাজনীতি উৎপল দত্ত বুনে দিয়েছেন, সেখানে আর রাজনীতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার পড়ে না। সমসাময়িক হওয়ার যুক্তিতে সেখানে অন্য নাটকের কোলাজ কিংবা সাম্প্রতিক ঘটনার টুকরো গুঁজে দিলে, কিংবা সম্প্রীতির খাতিরে গেরুয়া-পরা বিবেকের পাশে মুসলিম চরিত্র টেনে আনার নেশা দেখলে রবীন্দ্রনাথের মতোই বলতে ইচ্ছে করে— “যে দর্শক তোমার অভিনয় দেখিতে আসিয়াছে তাহার কি নিজের সম্বল কানাকড়াও নাই?... কতক তুমি বোঝাইবে, কতক তাহারা বুঝিবে, তোমার সহিত তাহাদের এইরূপ আপসের সম্বন্ধ।" কিন্তু প্রোপাগান্ডার ফাঁকে মেধার অহং যদি মাথা উঁচিয়ে থাকে, তবে সে কথা বুঝবে কে!

...................

#টিনের তলোয়ার #উৎপল দত্ত #Utpal Dutt #Bengali Play #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

54

Unique Visitors

182974