নিবন্ধ

বাস্তুছায়া : হানাবাড়ি ও ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্য

চয়ন সমাদ্দার June 19, 2021 at 10:42 am নিবন্ধ

গুণীজনে বলেন, আমাদের মনের মধ্যে অন্ধকারের প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। আমরা ক্রমাগত সন্ধান করে চলি প্রতীকের, আখ্যানের, বর্ণনার - যার সাহায্যে আমরা ভাষা দিতে পারব আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আড়ালে আবডালে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসা আদিম, হিংস্র, আতঙ্কবহ, সুতীব্র এক শক্তির অনুভবকে, যাকে আমরা জুড়ে থাকতে দেখি মৃত্যু-আঁধার-শাস্তি-অমঙ্গল-হিংসা-ধ্বংস এবং মৃত্যুর পরের অবস্থা নিয়ে ভাবনার সঙ্গে। যা আছে তার চেয়ে ভীষণতর কিছু, বীভৎসতর কিছুর কল্পনা করা মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। অন্যভাবে বলতে গেলে, মানুষ ভীতির অনুভূতিকে ভেতর থেকে ভালোবাসে। এই কারণেই ভয় নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়। লেখা হয় হরর-এর আখ্যান।

বিশ্বখ্যাত সাহিত্যতাত্ত্বিক J.A.Cuddon বলেন,  

“In the hands of a serious and genuinely imaginative writer the horror story, whatever length it may be, explores the limits of what people are capable of doing and the limits of what they are capable of experiencing. Thus he ventures (as he does in the tale of horror, terror and the ghost story :all three are closely related) into realms of psychological chaos, emotional wastelands, psychic trauma, abysses opened up by the imagination, the capacity for experiencing fear, hysteria and madness, all that lies on the dark side of the mind…, on and beyond the shifting frontiers of consciousness, where some kind of precarious vigilance and control are kept by the convention and taboo and by the repressive censors of feelings; and where, perhaps, there dwell ultimate horror or concepts of horror….”

(Introduction, The Penguin Book of Horror Stories)


অর্থাৎ, সত্যিকারের কল্পনাপ্রতিভাধর আর সিরিয়াস লেখকের হাতে ভয়ের গল্প, সে যে কোনো মাপেরই হোক না কেন - মানুষ কতদূর অনুভব করতে পারে, আর হাতেকলমে করে উঠতে পারে, তার সীমা যাচাই করে দেখতে চায়। তাই সে অভিযান চালায় (শিহরণ, আতঙ্ক বা ভৌতিক গল্পের সাহায্যে : তিনটেই খুব কাছাকাছি) সেই রাজ্যে যেখানে মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা, আবেগের পোড়োজমি, মানসিক যন্ত্রণা, কল্পনায় খোঁড়া আঁধার-গহ্বর, ভয় পাওয়ার সামর্থ, হিস্টিরিয়া, পাগলামি - অর্থাৎ মনের অন্ধকার দিকে যা বসত করে, তাদেরই রাজত্ব। চেতনলোকের দ্রুত পালটে যাওয়া সীমানা এবং তার ওপারে, যেখানে পরম্পরা আর ট্যাবু এক ধরনের অতি কমজোরি পাহারা আর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করে, যেখানে অবদমিত অনুভূতি নজরদারি করতে চায় কিন্তু পেরে ওঠে না - সেখানেই বাস করে চরমতম আতঙ্ক বা তার ধারণা।

‘ভয়’ বা ‘আতঙ্ক’ এই দুটো শব্দকেই ‘হরর’ কথাটা দিয়ে বোঝানো যায়। ল্যাটিন ‘Horreere’ থেকে এসেছে এই ইংরিজি শব্দ। এর অর্থ হলো মাথার চুল খাড়া করিয়ে দেওয়া আর কাঁপুনি ধরানো। তার মানে, যে ধরনের গল্প পড়লে ভয়ে কাঁটা হয়ে আমরা কাঁপতে থাকব, তাই হল সার্থক ভয়ের গল্প। 


খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠবে, এরকম গল্প লেখারই বা কী দরকার আর পড়ারই বা কী প্রয়োজন? সেটার উত্তর দেওয়ার জন্যই কাডন্‌-এর ঐ দীর্ঘ উদ্ধৃতি। মনোগহনের গহীন আঁধারের মধ্যেই ভয়ের বাস। তার ওপর নজরদারি চালায় সামাজিক দস্তুর আর অবদমিত আবেগের খবরদারি। সবসময় কিন্তু সফল হয় না তাদের চেষ্টা। সেই অন্ধকার বেরিয়ে আসে দুঃস্বপ্ন হয়ে। আমাদের মনে হয়, ওই অন্ধকার মুক্তি খোঁজে। আর তাকে মুক্তিদানের একটা উপায় হলো তাকে সাহিত্যের উপাদান করে তোলা। 


ভয়ের গল্পে ব্যবহার করা একটা চালু প্রকরণ হল, যা আমাদের নিরাপত্তা বা নিশ্চিন্ততার বোধ দেয় তাকেই ভয়াল করে তোলা। নিজের ঘরের চেয়ে নিশ্চিন্ত, নিরাপদ আশ্রয় আর কী থাকতে পারে? সেই ঘর যদি অশুভ কালো ছায়ার বাস্তুভূমি হয়ে ওঠে তবে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, তা সব অর্থেই কাঁপুনি ধরানো। এই কারণেই, দিশি বা বিলিতি হরর গল্পে হানাবাড়ি বা হন্টেড হাউস একটা বহুব্যবহৃত মোটিফ। আমরা মোট পাঁচটি ইংরিজি আর আমেরিকান কাহিনির নিরিখে বোঝার চেষ্টা করব, কীভাবে আর কেন হানাবাড়ি সাহিত্যের অংশ হয়ে ওঠে। 


তবে তার আগে আমাদের বুঝে নিতে হবে, আমরা যে দেশ দুটোর কথা আমরা বলেছি, সেখানে হানাবাড়ির একটা স্বীকৃত পরম্পরা আছে। ইংরেজরা খাস টাওয়ার অফ লন্ডনকেই হন্টেড বলে! সেখানে নাকি অষ্টম হেনরির দ্বিতীয়া স্ত্রী অ্যানি বোলিনের প্রেতচ্ছায়া ঘুরে বেড়ায়, হেনরির আদেশে টুকরো হয়ে যাওয়া কাউন্টেস অফ সেইলস্‌বেরি আজও তাঁর ঘাতকদের হাত থেকে ছুটে পালাতে চেষ্টা করেন, আর রাজা দ্বিতীয় চার্লস-এর অবৈধ পুত্র জেমস্‌ ক্রফ্‌টস স্কট-এর কবন্ধ হেঁটে বেড়ায় প্রাকারের ওপর। কাসল্‌ অফ গ্লেমিসে ছটফট করে অশান্ত আত্মারা। ওদিকে সাগরপারে, ক্যালিফোর্নিয়ার, সান জোসের উইঞ্চেস্টার ম্যানসন শুধু হানাবাড়িই নয়, অপঘাতে মৃত মিঃ উইঞ্চেস্টার ও তাঁর ছেলের নির্দেশ মেনে তৈরি করা। অন্তত ১৮৮৪ সালে, তাই বলেছিলেন মিসেস উইঞ্চেস্টার। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আমি আসলে বলতে চাইছি, হানাবাড়িকে গল্পে ব্যবহার করার সম্ভাবনা ইঙ্গ-মার্কিন সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যেই রয়েছে। লেখকরা সেটারই সদ্ব্যবহার করে থাকেন। এখন প্রশ্ন হল, কেন? 


আগে বলেছি, বাড়ি একটা আর্কেটাইপ। আমাদের কাছে নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীক। যে কোনও ভয়ের গল্পের লেখক তাকে এক অশুভ বাস্তু করে তুললে একটা শিউরে ওঠা ভয়ের জন্ম হয়। বাড়ি মানে আরাম, বিশ্রাম, নিশ্চিন্ত এক সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের প্রতীক। অন্যভাবে বলতে গেলে বাড়ি আমাদের অস্তিত্বের একটা বিস্তার। এখন সেখানে যদি অশুভ এক ‘অপর’ আমাদের সঙ্গী হয়, এনে হাজির করে আঁধারলোকের বিশৃঙ্খলা, আমাদের অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র টলে যায়। যা কিছু আমাদের পরিচিত, এক শীতলতা যেন তাকে অচেনা করে তোলে। বিখ্যাত আমেরিকান হরর লেখক স্টিফেন কিং বলেন, এর ফলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায়,

“When we go home and shoot the bolt on the door, we like to think we’re locking the trouble out. The good horror story about the Bad Place whispers-that we are not locking the world out, we are locking ourselves in…with them!”


বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করেও আমরা নিরাপদ নই। সত্যিকারের ভালো ভয়ের গল্প ফিসফিসিয়ে বলবে, এই হানাবাড়ি বা অশুভ স্থান-টির বাইরে স্বাভাবিক পৃথিবী। দরজা মধ্যে করে আমরা ওদের সঙ্গে নিজেদের আটকে ফেলেছি। আমার আশেপাশে তরল, ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত। 


চেনা পরিবেশ অচেনা হয়ে গেলে আসলে যা হয়, তা হল নিজের গড়ে তোলা আবহ, চরিত্র, নিজস্বতা, সব কিছুর যেন একটা বিকট প্রতিবিম্ব গড়ে ওঠে। আমাদের অবচেতনার অন্ধকার থেকে উঠে আসা আমারই প্রতিরূপ যদি আমার সযত্নে রচিত ইমেজকে এবং যা যা সেই ইমেজকে সুরক্ষিত রাখে, তাকে আক্রমণ করে, তখন আমি যে মানসিকতার শিকার হই, ফ্রয়েড তাকে বলেন, ‘আনক্যানি’। তার সঙ্গে মিশে থাকে যা কিছু ভয়াবহ, যা কিছু চূড়ান্তভাবে আতঙ্কজনক, তাদের অনুষঙ্গ। যখন ‘হিমলিশ’ (চেনা ও অভ্যস্থ) এবং ‘আনহিমলিশ’ (অচেনা ও অনভ্যস্থ)–এর মধ্যেকার ব্যবধান ঘুচে যায়, তখনই জন্ম নেয় এই ‘আনক্যানি’-র বোধ। ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যে ভয়ের গল্পে সাহিত্যিক প্রকরণ হিসেবে হানাবাড়ির ব্যবহার এই আনক্যানিকেই কথাশরীর দিয়ে পাঠকের মগ্নচেতনায় বুনে দেয়, যার ফলে জন্ম নেয় এক বিপন্নতা। আদিম আতঙ্ক তাকে আশিরনখ শিহরিত করে। এবার আমরা গল্পগুলোকে দেখতে পারি। 



শেক্সপীয়র আর স্পেনসারের রচনায় কিছু আভাস দেখা গেলেও, ইংরিজি সাহিত্যে হানাবাড়ি ১৭৬৫ সালের আগে পূর্ণ গৌরবে আত্মপ্রকাশ করেনি। ওই বছরই প্রকাশিত হয়, হোরেস ওয়লপোলের ‘দ্য কাসল্‌ অফ ওটরান্টো’ দেখতে দেখতে ১৫০টা সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। ভূত, চোরকুঠুরি, জ্যান্ত মূর্তি, আর আতঙ্ক, যন্ত্রণা আর প্রেম দিয়ে গড়া এই বইতে একটা ভীষণ অসুখী পরিবারের গল্প পড়ি আমরা। ছেলে কনরাডের বীভৎস অপঘাত মৃত্যুর পর স্ত্রী হিপ্পোলিটাকে ডিভোর্স করে, কনরাডের হতে হতে না হওয়া স্ত্রী ইসাবেলাকে বংশরক্ষার জন্য বিয়ে করতে চান প্রিন্স ম্যানফ্রেড। সমস্ত পরিবেশ যেন অশুচি হয়ে ওঠে। এরপর ইসাবেলার পালানো, ম্যানফ্রেডের তাকে ধরার চেষ্টা, থিওডোরের ইসাবেলাকে রক্ষা করা, ম্যানফ্রেডের মেয়ে মাটিলডা আর ইসাবেলার একইসঙ্গে থিওডোরের প্রেমে পড়া, হিংসায় উন্মাদ ম্যানফ্রেডের থিওডোরের সঙ্গে ইসাবেলাকে দেখে তাকে ছুরি মেরে আবিষ্কার করা যে তিনি নিজের হাতে নিজের মেয়ে মাটিলডাকে খুন করেছেন। এর মধ্যে আশপাশের পরিবেশ রক্তগন্ধময় হয়ে উঠছিল, এই হত্যার পরই ওটরান্টো কাসল্‌ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। 


তাঁর নিজের বাসস্থান স্ট্রবেরি হিলের আদলে ওটরান্টো কাসল্‌ গড়েন ওয়লপোল এবং বলেন, এই কাহিনিতে তিনি যেসব কল্পনা, ভিশন, আর উগ্র আবেগ তাঁর দম বন্ধ করে আনছিল তাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে এটাই এই বইয়ের পশ্চিমি কল্পনার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কারণ। বইটির কাহিনি, সংলাপ, চরিত্রচিত্রণ, অতিলৌকিক উপাদান কোনোকিছুকেই অসাধারণ বলা চলে না। তবুও, ওয়লপোল যে হানাবাড়ির আর্কেটাইপ গড়ে তুলেছেন তা একটা মডেল হয়ে গেছে, কারণ তিনি দেখিয়েছেন, প্রকৃত আতঙ্ক লুকিয়ে রয়েছে একটা প্রাচীন অভিজাত পরিবারের বাসস্থানে যুগের পর যুগ জমা হওয়া রকম-বেরকমের পাপের মধ্যে, ভেঙে পড়া পরিবারের মধ্যে, নির্লজ্জ কামনা, হিংসা ও অকারণ রক্তপাতের মধ্যে। বাস্তুর মধ্যে জমা অশুচিতার কালো ছায়ার ভয়ালতা জ্যান্ত পোর্ট্রেট, চলন্ত বর্ম, প্রেতাত্মা – এসবের চেয়ে অনেক বেশি। তাই, এই বাড়ি ভেঙে পড়ার আসল মানে হলো সন্তানশোক থেকে জন্মানো তীব্র অনুতাপের আগুনে পুড়ে কাসল্‌ অফ ওটরান্টোর আনাচেকানাচে জমা মানুষের অন্ধকার প্রবৃত্তির বিনাশ। 


মানুষের গড়া এই আতঙ্কভুবনকে তাঁর অসামান্য সাহিত্যিক প্রতিভায় নতুন রূপ দিয়েছিলেন এডগার অ্যালান পো, ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য ফল অফ দ্য হাউস অফ আশার’ গল্পে। নামহীন এক কথক এসে পৌঁছেছেন বাল্যবন্ধু রোডরিক আশার-এর বাড়ি এবং দেখছেন বাড়িটার ছাদ আর সামনের দিকটায় চিড় ধরেছে। রোডরিক দেহে মনে অসুস্থ। তার যমজ বোন ম্যাডেলিন সদ্য মারা গেছে। রোডরিক গাইছে, ‘দ্য হন্টেড প্লেস’। বন্ধুকে অন্যমনস্ক রাখার জন্য কথক তাকে এক নাইটের অভিযানের গল্প পড়ে শোনাচ্ছেন। গল্প যত এগোচ্ছে, তত গল্পের বিশ্ব আর এই বাড়িটা এক হয়ে উঠছে যেন। শোনা যাচ্ছে অনৈসর্গিক শব্দ। এই সময়, দরজা ভেঙে উড়ে যায়, সামনে এসে দাঁড়ায় ম্যাডেলিনের দেহ, আছড়ে পড়ে ভাইয়ের শরীরের ওপর, রোডরিক মারা যায়। প্রাণ নিয়ে পালানোর সময়, কথক দেখেন, বাড়িতে ধরা চিড়টা চওড়া হচ্ছে, ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলো। তাঁর চোখের সামনে আশার-দের বাড়ি দু টুকরো হয়ে লেকে তলিয়ে যায়। 


এই গল্পেও অতিলৌকিককে ছাপিয়ে যায় লৌকিক আতঙ্ক। আসলে আশার-দের পরিবারেও জমা ছিল বহু অন্ধকার, অসুস্থতা – যা কায়া নিয়েছে রোডরিকের অসুখের মধ্যে। গল্পটা যেভাবে শেষ হয় তাতে বোঝা যায়, ভাই-বোনের মধ্যে একটা ইনসেস্টের সম্পর্কের দিকে আঙুল তুলছে আখ্যান। পুরো বাড়িটা এখানে ভেঙে পড়া পরিবার, এমনকি হয়তো বা মগ্নচেতনার প্রতীক। ফাটল ধরেছে তাতে। বাস্তুর ওপর বিছানো প্রবৃত্তির কালো ছায়া শেষ অবধি ধ্বংস ডেকে আনছে। 


১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয় শার্লট ব্রন্টির ‘জেন আয়ার’। এই উপন্যাস এতটাই বিখ্যাত যে এর কাহিনি অংশ আলোচনা না করলেও চলবে। সামাজিক নীতিবোধ আর প্রথার পরোয়া না করা প্রবল ‘পুরুষ’ রচেস্টারের বাড়ি থর্নফিল্ড হলে কাজ করতে এসে জেন রচেস্টারকে ভালোবাসে। কিন্তু, বাড়িটা তাকে বিচলিত করে। কে যেন আছে এখানে। কার যেন উপস্থিতি টের পায় জেন। বাড়ির ওপর তলায় নানারকম শব্দ। এটা কি হানাবাড়ি? রচেস্টার আর জেনের বিয়ের ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগে, জানা যায়, থর্নফিল্ড হলের চিলেকোঠায় বন্দিনী রয়েছে রচেস্টারের প্রথম স্ত্রী বার্থা মেসন। জেন সহ্য করতে না পেরে পালায়। 


বার্থাকে উন্মাদিনী আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু, বস্তুত সে জেনের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু নয়। ঘরোয়া জেন যে সব উদগ্র আবেগ প্রকাশ করতে পারে না, সেগুলোই বার্থার মধ্যে এনেছেন ব্রন্টি। বার্থার আক্রোশ শুধু রচেস্টারের ওপর। রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি নেমে এসে জেনের বিয়ের ভেইল্‌ ছিঁড়ে ফেললেও, জেনের কোনও ক্ষতি করে না সে। আসলে, বার্থা চরিত্র আর থর্নফিল্ড হল একসঙ্গে মেয়েদের বন্দীদশা, দাম্পত্যের দম আটকানো অনুভূতি এবং তার থেকে মুক্তি চাওয়াকে প্রকাশ করে। আর এই তীব্র চাওয়ার জন্যই থর্নফিল্ড হলে আগুন লাগে। অন্ধ, পঙ্গু রচেস্টার আর আগ্রাসী পৌরুষের প্রতীক নয় বলে জেন নির্ভয়ে তাকে গ্রহণ করে, সুশ্রূষার মাধ্যমে। 


ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যে হানাবাড়ি নিয়ে লেখা কাহিনির মধ্যে ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হেনরি জেমসের ‘দ্য টার্ন অফ দ্য স্ক্রু’ এক বিশেষ স্থানের দাবি করে। এসেক্সের ‘ব্লাই’ নামের বাড়িতে এক নামহীনা গভর্নেসের তত্ত্বাবধানে রয়েছে দুই অনাথ ভাই-বোন - মাইলস্‌ আর ফ্লোরা। মাইলস্‌-ফ্লোরার কাকা তাদের বিষয়ে উদাসীন। ছেলেটিকে বোর্ডিং স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে এই বিষয়ে মুখ খুলতে অনিচ্ছুক। গভর্নেস বোঝে কিছু একটা রহস্য আছে, কিন্তু সে মাইলস্‌-কে জোর করে না। এই সময়, বাড়ির সামনের মাঠে এক নারী ও এক পুরুষের ছায়ামূর্তি দেখা যেতে থাকে। জানা যায় এরা গভর্নেসের পূর্বসূরি জেসেল আর তার প্রণয়ী পিটার কুইন্ট-এর প্রেতাত্মা। গভর্নেস সন্দেহ করে, দুই ভাই-বোন প্রেতমূর্তিদের সঙ্গে কথা বলে থাকে। এরপর, ফ্লোরা একদিন লন্ডন যায়। মাইলস্‌ জানায় কেন তাকে বোর্ডিং হাউস ছাড়তে হয়েছে। সে নোংরা কথা বলেছিল। এই সময় জানলায় ভেসে ওঠে এক প্রেতমূর্তি। মাইলস্‌ জানতে চায়, জেসেল এসেছে কিনা। কিন্তু যখন সে জানে কুইন্টের প্রেত তার দিকে চেয়ে রয়েছে, তখনই সে মারা যায়। 


সারা বই জুড়ে সেই বাড়ি আর আলো-আঁধারি মোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাহিনি এমন ভাবে বলা যে, মনে হবে ওই সব প্রেতচ্ছায়া মানসিকভাবে অসুস্থ গভর্নেসের মনের গভীর থেকে উঠে আসতে পারে, আবার সত্যিও হতে পারে। কুইন্টের সঙ্গে মাইলস্‌-এর কোনও গোলমেলে সম্পর্ক ছিল আর সে-ই ছেলেটিকে অশ্লীল কথা শিখিয়েছিল - এমনটিও মনে করেন কেউ কেউ। সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বলেই ‘দ্য টার্ন অফ দ্য স্ক্রু’ আজও সমান আকর্ষণীয়। তবে একথাও সত্যি, এই বই শেষ করার পর মনে হবে, বাস্তুভিটের মধ্যে অসুস্থ সম্পর্ক, ব্যাধি আর অশুচিতা (মাইলস্‌ এর ওপর গভর্নেসের আকর্ষণ)–র দম বন্ধ করা অন্ধকার দিয়ে এর কাহিনি-বিশ্ব রচিত। 


১৯২১ সালে ভার্জিনিয়া উল্ফ একটা ছোটোগল্প লেখেন। তার নাম ‘আ হন্টেড হাউস’। কথক একটা বাড়ির কথা বলেন, যেখানে বাস করেন এক নারী ও তার প্রণয়ী। বাড়িটিতে নানারকম শব্দ শোনা যায়, ঘর থেকে ঘরে ঘুরে বেড়ায় এক দয়িত-দয়িতার প্রেতচ্ছায়া। তারা কিছু খোঁজে। বাইরে বসে তাদের অনুসন্ধানের শব্দ শোনা যায়। কিন্তু ভেতরে গেলে তারা মিলিয়ে যায়। রাতের বেলা এই ‘গোস্টলি কাপল্‌’ লুকোনো আনন্দ খোঁজে। কথক অনুভব করেন, তারা তাঁর বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছে এসে। ঘুম ভাঙে যখন, তখন কথক বোঝেন, কোন গুপ্ত সম্পদের খোঁজে ফিরছে তারা, তা যেন তিনি বুঝতে পারছেন : সেই গুপ্তধনের নাম হৃদয়ের আলো। 


এই গল্প ভৌতিক কাহিনির প্রচলিত উপকরণ, হানাবাড়ি, সব কিছুই ব্যবহার করে। তবু, এর প্রকৃতি গদ্যকবিতার। বাড়ি জুড়ে মন্ত্রের মতো একটা স্পন্দন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় – safe, safe, safe; আর ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে কথক আবিষ্কার করেন হৃদয়ের আলো। বলা যেতে পারে, হানাবাড়ির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষের পাপ, অপরাধ, নোংরামি-র অনুষঙ্গের একেবারে উলটো দিকে দাঁড়ায় এই গল্প। আলোও যেমন, কালোও তেমন শিল্পীর সৃজন। অতিলৌকিক উপকরণ ব্যবহার করে, কবিতার শুদ্ধিতে হানাবাড়িতে চলে ফিরে বেড়ানো বাস্তুছায়ার exorcism করে ভার্জিনিয়া উল্ফের গল্প ঘরের নিরাপত্তা আবার ফিরিয়ে আনে, এ কথা বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না। 


হানাবাড়ি, ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যে একটা ট্রোপ, তার বেশি কিছু নয়। শক্তিশালী সাহিত্যিকরা বিভিন্নভাবে প্রমাণ করেন, মানুষের প্রবৃত্তি, তার সুকৃতি-দুষ্কৃতি এইসব বাড়ির আবহে নিজের ছাপ রেখে যায়। হানাবাড়ির গল্প পড়ে আসলে আমরা নিজেদের মুখোশের আড়ালে লুকোনো মুখ দেখে ভয় পাই। আবার, নিজেদের গোপন আনন্দের সন্ধানও পাওয়া যেতে পারে এখানে। সবকিছুই আমাদের চেতনার ওপর নির্ভর করছে। 


ভয়ই দেখাক আর আশার কথাই বলুক, এই ক’টি কাহিনির নিরিখে আমরা এবার বলতে পারি, সেই শুরুর কাল থেকে শক্তিশালী ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যে হানাবাড়ি আসলে মানুষেরই গল্প বলে - ভূতের নয়। অতিলৌকিকের আলো আসলে উজ্জ্বল করে আমাদের লৌকিক জগৎ। আমরা, এইসব গল্প পড়ে নিজেদের আরেকটু বেশি করে চিনি। বুঝি, আমাদেরই আলো-আঁধারি গড়ে তোলে হানাবাড়ি। আর এই গড়ে তোলার কাজটা হয় ভাষা দিয়ে। 


যা গড়েছে বাস্তুভিটে, তাই গড়েছে ভয়। আবার, ভাষা-জাদুই ভয় ভুলিয়ে কল্যাণমন্ত্র উচ্চারণ করতে পারে। 


হানাবাড়ির অবস্থান আসলে টেক্সটের মধ্যে। আর, টেক্সটের বাইরে আর কিছুই নেই। 





[কভার ছবি: The House of Usher. Illustration by Czech artist Matěj Čadil]
#বাংলা #নিবন্ধ #হানাবাড়ি #ইঙ্গ সাহিত্য #মার্কিন সাহিত্য #টাওয়ার অফ লন্ডন #অ্যানি বোলিন #কাউন্টেস অফ সেইলসবেরি #জেমস্‌ ক্রফ্‌টস স্কট #উইঞ্চেস্টার ম্যানসন #হোরেস ওয়লপোল #দ্য কাসল্‌ অফ ওটরান্টো #দ্য ফল অফ দ্য হাউস অফ আশার #এডগার অ্যালান পো #শার্লট ব্রন্টি #জেন আয়ার #হেনরি জেমস #দ্য টার্ন অফ দ্য স্ক্রু #ভার্জিনিয়া উল্ফ #আ হন্টেড হাউস #চয়ন সমাদ্দার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

69

Unique Visitors

183694